জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন নিয়ে গরম হাওয়া বইছিল ক্যাম্পাসে। ডাকসুর রোডম্যাপ, ডাকসুর নির্বাচন কমিশন, তফসিল, নির্বাচনের তারিখ সর্বোপরি ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে বিক্ষোভ, অনশন, অবস্থান কর্মসূচিতে জুন পর্যন্ত সরগরম ছিল ক্যাম্পাস।

গত ১৫ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ডাকসুর টাইমলাইন ঘোষণা করলে সে অনুযায়ী শুরু হয় ডাকসু চেয়ে সাধারণ শিক্ষার্থী ও ছাত্র সংগঠনগুলোর নানা কর্মসূচি। সেই থেকে ক্যান্টিনে খাবারের ফাঁকে কিংবা চায়ের কাপে ধোঁয়া ওঠা আলাপে একটাই প্রশ্ন, ‘ডাকসু কবে’? অবশেষে ১৬ জুন ডাকসুর নির্বাচন কমিশন গঠনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে জানা যায়, আগামী আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে ডাকসু নির্বাচন হতে যাচ্ছে। নির্বাচন কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংগঠন, ডাকসু নির্বাচনের জন্য গঠিত উপদেষ্টা পরিষদ এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও শিক্ষামূলক সংগঠনের সঙ্গে ইতোমধ্যে আলোচনা করেছে। এখন বাকি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা ও ভোটার তালিকা প্রণয়ন।

পেছনে ফেলে আসা ডাকসুর অচলাবস্থার ইতিহাস

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র ৩৭ বার ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে হয়েছে ২৯ বার আর স্বাধীন বাংলাদেশে মাত্র ৮ বার। অথচ ১৯৭৩ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুযায়ী, প্রতিবছর ডাকসু ও হল সংসদের নির্বাচন হওয়ার কথা।

২০১৯ সালের বিতর্কিত নির্বাচনটি অনেক আশা জাগিয়ে এলেও তা শেষ পর্যন্ত বিতর্ক, অনিয়ম আর অভিযোগে আচ্ছন্ন হয়েছিল। এরপর দীর্ঘ পাঁচ বছরের বেশি সময় অচলাবস্থার মধ্যে ছিল ডাকসু।

৩৮তম ডাকসু : নতুন করে জেগে ওঠার সম্ভাবনা

শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ আন্দোলন ও দাবির পর অবশেষে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে সাড়া পড়েছে প্রশাসনে। গেল ১৬ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় নির্বাচন কমিশন গঠনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তাই এখন ক্যাম্পাসজুড়ে বইছে নির্বাচনী হাওয়া। সংগঠনগুলো প্যানেল গঠনে তৎপর, স্বতন্ত্ররাও নিচ্ছে প্রস্তুতি।

শিক্ষার্থীদের মতে, জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান এবং নতুন বাংলাদেশ গঠনের প্রত্যাশা অনুযায়ী ডাকসুকে হতে হবে ইতিহাস সচেতন, অংশগ্রহণমূলক ও স্বচ্ছ। নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা, ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা এবং প্রশাসনে মানবিক ভূমিকা নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রয়োজন কাঠামোগত সংস্কার, যাতে ভবিষ্যতে ডাকসু আর অচল না হয়।

তারা একটি স্বচ্ছ, গণতান্ত্রিক ও কার্যকর ডাকসু চান, যা কোনো রাজনৈতিক প্রভাব ছাড়া সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবে এবং শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষা করবে। শিক্ষার্থীরা চান, ডাকসু একাডেমিক সমস্যা সমাধান, সিট বণ্টনে স্বচ্ছতা, যৌক্তিক দাবিতে প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয়, নারী ও প্রান্তিক শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করুক। ডাকসু যেন কেবল রাজনৈতিক নয়, বরং সংস্কৃতি, ক্রীড়া, বিতর্ক, গবেষণা ও নেতৃত্ব বিকাশের জবাবদিহিমূলক একটি সক্রিয় প্ল্যাটফর্ম হয়ে ওঠে, এটাই তাদের প্রত্যাশা।

তাদের ভাষ্য, এবারের ডাকসু নির্বাচনের দাবি কেবল একটি ভোটের আহ্বান নয়, এটি ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এক গণতান্ত্রিক প্রতিরোধের ঘোষণা।

শিক্ষার্থীরা কেমন ডাকসু চান?

কেমন ডাকসু চান– এমন প্রশ্নে ঢাবির বিভিন্ন শিক্ষাবর্ষের ও বিভাগের শিক্ষার্থীরা তাদের মতামত ব্যক্ত করেছে ঢাকা পোস্টের কাছে।

‘গণআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ও নতুন বাংলাদেশের স্পিরিটে ইতিহাস-সচেতন ডাকসু চাই’
রায়হান আহম্মেদ সিব্বির
লোকপ্রশাসন, ২০২০-২১

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে চলছে নানাবিধ সমীকরণ, হিসাবনিকেশ ও তোড়জোড়। চলছে প্যানেল-স্বতন্ত্র বিতর্ক। ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। সংস্কার করা হয়েছে গঠনতন্ত্র। সৃষ্টি করা হয়েছে নতুন চারটি পদ। অংশীজনদের সঙ্গে চলছে ধারাবাহিক আলোচনা। অর্থাৎ, এবার ডাকসু হচ্ছে। এটি আর গুঞ্জন নয়, এটি এখন এক গণতান্ত্রিক আলটিমেটাম, এক চরমপত্র।

দীর্ঘ ২৮ বছর অচল থাকার পর ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন। তবে ওই নির্বাচন ছিল প্রশ্নবিদ্ধ, ফ্যাসিবাদী পৃষ্ঠপোষকতায় আওয়ামী-ছাত্রলীগের মদতে এবং ভোট কারচুপির অভিযোগে ভরপুর। তবে এবার আমরা এক নতুন বাংলাদেশে প্রবেশ করেছি।

জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর আমরা যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছি এবং ফ্যাসিবাদী কাঠামো বিলোপের অঙ্গীকার করেছি, এখন সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের সময়। এখন সময় গণআকাঙ্ক্ষার নেতৃত্ব বেছে নেওয়ার।

আসন্ন ডাকসু নির্বাচন হতে হবে ইতিহাস-সচেতন, অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ ও আধুনিক ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত– নতুন বাংলাদেশের চেতনায় উজ্জীবিত। সম্ভাব্য নেতৃত্বকে দিতে হবে একটি স্পষ্ট ও বাস্তবসম্মত ম্যানিফেস্টো। প্রশাসনের দায়িত্ব হবে নিরপেক্ষতা ও ন্যায়নিষ্ঠতা বজায় রাখা।

আগস্ট পরবর্তী সময়ের ‘স্টেট অব নেচার’-এর প্রভাব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়েছে। আইনশৃঙ্খলার অবনতি, মব ভায়োলেন্স এবং হত্যাকাণ্ড উদ্বেগজনক। তাই প্রশাসনের প্রতি আহ্বান থাকবে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে দ্রুত নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হোক এবং কমিশনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা হোক।

‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতন্ত্র চর্চার মহৌষধ ও ডাকসু’
আশরাফুর রহমান
রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ২০২২-২৩

ডাকসু নিয়ে আলোচনা উঠলেই চোখে পড়ে স্বাধীনতার পর গত ৪৬ বছরে মাত্র ৮ বার নির্বাচন হয়েছে, যা অত্যন্ত হতাশাজনক। এবার যখন নতুন করে ডাকসু নির্বাচনের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে, তখন আমাদের প্রত্যাশা স্পষ্ট।

আমি চাই একটি নিয়মিত, স্বচ্ছ, সুষ্ঠু ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে গঠিত ডাকসু, যা হবে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত প্রতিনিধিত্বকারী, জবাবদিহিমূলক ও সক্রিয়। এটি এমন একটি প্ল্যাটফর্ম হোক, যেখানে রাজনৈতিক প্রভাব নয়, বরং থাকবে অংশগ্রহণমূলক নেতৃত্ব, সহমর্মিতা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে দায়বদ্ধতা।

বিশ্ববিদ্যালয়কে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক চর্চার কেন্দ্রে পরিণত করতে ক্যালেন্ডারভুক্ত ও কার্যকর ডাকসু অত্যাবশ্যক। যেমন একটি দেশের জন্য গণতন্ত্র জরুরি, তেমনি একটি সচল ডাকসুই পারে বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাণবন্ত ও আদর্শ প্রতিষ্ঠানে রূপ দিতে, যেখান থেকে জন্ম নেবে ভবিষ্যতের নেতৃত্ব।

‘নিরাপদ, অংশগ্রহণমূলক ডাকসু চাই’
নুসরাত জাহান
প্রিন্টিং ও পাবলিকেশন, ২০২৩-২৪

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি চাই একটি গণতান্ত্রিক, অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু ডাকসু নির্বাচন, যেখানে শিক্ষার্থীরা নির্বিঘ্নে ও নির্ভয়ে ভোট দিতে ও প্রার্থী হতে পারবে। এমন একটি পরিবেশ প্রয়োজন, যেখানে রাজনৈতিক প্রভাব নয়, বরং নেতৃত্ব, দায়বদ্ধতা ও শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষাই হবে মুখ্য।

২০১৯ সালের পর থেকে আর কোনো ডাকসু নির্বাচন না হওয়ায় প্রতিনিধিত্ব শূন্যতা তৈরি হয়েছে। নিয়মিত, স্বচ্ছ ও উন্মুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে এই শূন্যতা দূর করতে হবে।

আমি এমন একটি ডাকসু চাই, যা রাজনীতিমুক্ত ও শিক্ষার্থীদের কল্যাণে নিবেদিত থাকবে, যেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে, ভয় বা চাপ নয়। আমাদের প্রয়োজন এমন নেতৃত্ব, যারা কেবল আশ্বাস নয়, বাস্তব সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

প্রকৃত নেতৃত্বের জন্য প্রয়োজন একটি অংশগ্রহণমূলক, ন্যায়ভিত্তিক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থা। তাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আন্তরিকতা ও শিক্ষার্থীদের ঐক্যই পারে একটি নিরাপদ, গ্রহণযোগ্য ডাকসু নিশ্চিত করতে।

‘কার্যকর ডাকসুই শিক্ষার্থীর অধিকার রক্ষার প্রধান মাধ্যম’
আহসান খান
ইসলামিক স্টাডিজ , ২০২২-২৩

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব ও অধিকার আদায়ের প্রধান মাধ্যম ডাকসু। দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকার পর এটি ২০১৯ সালে কোটা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে পুনরায় অনুষ্ঠিত হলেও ভোট কারচুপি ও অনিয়মের কারণে শিক্ষার্থীরা প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব থেকে বঞ্চিত হন।

আমরা চাই একটি স্বচ্ছ, নিয়মিত ও কার্যকর ডাকসু, যেখানে নেতৃত্ব আসবে প্রকৃত শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে। ছাত্রত্বহীনদের নেতৃত্বের সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। ২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলনে নতুন বাংলাদেশের যে স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল, তা প্রশাসনের বয়সসীমা ও এমফিল শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে।

ডাকসুর নেতৃত্ব এমন হওয়া উচিত, যারা আন্তরিকভাবে কাজ করবে শিক্ষার্থীদের আবাসন, ক্যান্টিন, মানসিক স্বাস্থ্য ও একাডেমিক উন্নয়ন নিয়ে।

ডাকসু হোক স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও শিক্ষার্থীদের আস্থার প্রতীক, যা শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষা করবে দৃঢ়ভাবে।

‘রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ডাকসু চাই’
উম্মে সালমা
ইংরেজি বিভাগ, ২০২০-২১

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এমন একটি ডাকসু চান, যা সত্যিকার অর্থে তাদের প্রতিনিধিত্ব করবে এবং আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাবে। তারা চায় একটি স্বচ্ছ, গণতান্ত্রিক ও কার্যকর ডাকসু, যেখানে নেতৃত্ব নির্ধারিত হবে সরাসরি ভোটে, কোনো রাজনৈতিক প্রভাব ছাড়াই।

২০১৯ সালের নির্বাচনে অনিয়ম ও জোরপূর্বক ভোটগ্রহণের অভিযোগে শিক্ষার্থীরা হতাশ হয়। তাই ভবিষ্যৎ নির্বাচন সুষ্ঠু হবে তা নিশ্চিত করতে প্রশাসনের কঠোর ভূমিকা প্রত্যাশা করছি আমরা।

ডাকসুর দায়িত্ব হওয়া উচিত একাডেমিক সমস্যা সমাধান, হলের সিট বণ্টনে স্বচ্ছতা, যৌক্তিক দাবিতে প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় এবং নারী ও প্রান্তিক শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষা।

শিক্ষার্থীরা চান, ডাকসু কেবল রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম না হয়ে সংস্কৃতি, ক্রীড়া, বিতর্ক, গবেষণা ও নেতৃত্ব গঠনের একটি সক্রিয় মঞ্চ হয়ে উঠুক। আর্থিক স্বচ্ছতা, নিয়মিত প্রতিবেদন ও শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে এটি যেন একটি জবাবদিহিমূলক সংগঠন হিসেবেও প্রতিষ্ঠা পায়, এটিই তাদের প্রত্যাশা।

এসএআর/এসএসএইচ