করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে ২০২০ সালের মার্চের মাঝামাঝি থেকে বন্ধ রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের দীর্ঘ এ সময় শিক্ষার্থীরা নানা জটিলতায় পার করছেন। এ সময়ে পারিবারিক ও সামাজিক নানা চাপে পড়তে হয়েছে তাদের। অনেকে এসব চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রবণতা রোধে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

বিভাগ ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, করোনাকালে আত্মহত্যা করেছেন ঢাবির সাত শিক্ষার্থী। তারা হলেন- প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তৌহিদুল ইসলাম সিয়াম, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ইমাম হোসাইন, ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ফারিহা তাবাসসুম রুম্পা, চারুকলা অনুষদের গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শুভজ্যোতি মন্ডল, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী কামরুল বাহার, ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী জাকারিয়া বিন হক শুভ, দর্শন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী তরুণ সেন। এছাড়া গত ১৫ মে তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমান মাদক গ্রহণ করে আত্মহত্যা করেন বলে জানা যায়।

এসব শিক্ষার্থী কেন আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন তার সঠিক কোনো তথ্য নেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে। পরামর্শদান দফতর থাকলেও সেখানে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য সংরক্ষণ করা হয় না। তবে নিহত শিক্ষার্থীদের পরিবার ও সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিষণ্নতা, শিক্ষাজীবন নিয়ে হতাশা, সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে তারা আত্মহননের পথ বেছে নেন।

করোনায় আতঙ্কিত ও হতাশাগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে গতবছরের ৭ এপ্রিল প্রথমবার উদ্যোগ নেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের তত্ত্বাবধানে ৩০ মে পর্যন্ত চলে এ সেবা কার্যক্রম। এরপর চলতি বছরের ২৩ এপ্রিল ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের উদ্যোগে প্রশিক্ষণরত চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীদের মাধ্যমে অনলাইনে (WhatsApp) বা মোবাইল ফোনে বিনামূল্যে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়।

সর্বশেষ রোববার (১২ জুন) এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের উদ্যোগে হলের ছাত্রীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য প্রতি রোববার রাত ৮টায় বিশেষ সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। এতে বলা হয়, সেমিনারে অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের এই নাম্বারে (০১৭১৮-৭৭১৪৮৫) ভাইবার ও হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে বলা হচ্ছে। যেসব ছাত্রীর জরুরি স্বাস্থ্যসেবা দরকার, তারা ফেসবুক মেসেঞ্জারের মাধ্যমে প্রতি শনি, সোম ও বুধবার সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সাইকোলজিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হল এবং বিভাগে শিগগিরই এই কার্যক্রম শুরু হবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারপারসন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-নির্দেশনা ও পরামর্শদান দফতরের পরিচালক অধ্যাপক ড. মেহজাবীন হকের তত্ত্বাবধানে এসব সেবা কার্যক্রম পরিচালিত হবে।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধিতে আমরা সব সময় কাজ করছি। বিশেষ করে করোনা শুরুর এক মাস পরই এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের তত্ত্বাবধানে আমরা বিনামূল্যে এ সেবা পোঁছে দিচ্ছি। প্রত্যেক হল-বিভাগকে আমরা জানিয়ে দিচ্ছি যাতে এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের যত্ন নেওয়া হয়। আমাদের একটি হটলাইন সব সময় চালু থাকে, শিক্ষার্থীরা যেকোনো সময় সেবা নিতে পারে। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে আমরা সর্বদা সচেতন।

এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. মেহজাবীন হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য আমাদের যে ছাত্র-নির্দেশনা ও পরামর্শদান দফতর রয়েছে, সেখান থেকে অনলাইনে কাউন্সেলিং সেবা দেওয়া হচ্ছে। আমরা বিভাগ/ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে সব শিক্ষার্থীর কাছে হটলাইন নাম্বারটা পৌঁছে দিচ্ছি, যাতে যেকোনো প্রয়োজনে অনলাইনে বিনামূল্যে এ সেবাটা নিতে পারে। আর বিভাগ-হলগুলো চাইলে আমরা সেমিনার আয়োজনেও সহযোগিতা করছি।

কেন শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যার দিকে যাচ্ছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, করোনাকালে পুরো বিশ্বেই আত্মহত্যার পরিমাণ বেড়ে গেছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কারণে মানুষ নিজেকে ঘরে আবদ্ধ রেখেছেন এবং শিশু ও কিশোররা তাদের স্বভাবজাত চাঞ্চল্য দমিয়ে রাখতে বাধ্য হচ্ছে। এছাড়া ভবিষ্যৎ নিয়ে শিক্ষার্থীরা অনিরাপত্তায় ভুগছে। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভিন্ন মানসিক চাপ তৈরি হওয়া, আতঙ্কিত ও হতাশাগ্রস্ত হওয়া অস্বাভাবিক নয়।

ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিয়ে এই সাইকোলজিস্ট বলেন, এটা আমাদের সবার জন্য, বিশেষ করে তরুণদের জন্য খারাপ সময়। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে এটা সাময়িক, এটা চলে যাবে। একবছর, দুই বছর কিংবা সর্বোচ্চ তিন বছর থাকবে। এরপর তো আমরা এখান থেকে বের হয়ে আসতে পারব। যতদিন না এই খারাপ সময়টা থাকবে, ততদিন আমাদের একটু ধৈর্য সহকারে সময়টা পার করতে হবে।

এইচআর/এসএসএইচ