করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে যখন রোগীরা অক্সিজেন সেবা পাচ্ছিলেন না, এক শ্রেণির মানুষ অক্সিজেনের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছিল। ঠিক সেই সময় বিনামূল্যে অক্সিজেন সেবা দিয়ে মানুষের হৃদয় কেড়েছেন ছাত্রলীগের তিন নেতা।

গত বছরের ২৫ জুন ‘একটি নতুন ভোরের প্রতীক্ষা’ স্লোগানে ডাকসুর সাবেক স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাদ বিন কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে এই সেবা কার্যক্রম শুরু হয়। এই সেবার অন্য দুজন উদ্যোক্তা হলেন, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উপ-বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক সবুর খান কলিন্স এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম সবুজ। 

শুক্রবার (২৫ জুন) এই মানবিক সেবা কার্যক্রমের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। এক বছরে সেবা পেয়েছেন প্রায় ৭ হাজার ৬৫৯ জন মানুষ। সেবা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ২০ জন স্বেচ্ছাসেবক। পরিবারসহ আক্রান্ত হয়েছেন প্রধান উদ্যোক্তা সাদ বিন কাদের চৌধুরী। তবুও তারা থেমে যাননি, থেমে যেতে দেননি।

‘জয় বাংলা অক্সিজেন সেবা’ টিমের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, মাত্র ১২টি সিলিন্ডার দিয়ে এ সেবা কার্যক্রম শুরু হলেও এখন সিলিন্ডারের  সংখ্যা ১৪০টি। গত বছর ২৫ জুন ঢাকায় শুরু হওয়া এ সেবা কার্যক্রম পর্যায়ক্রমে চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, সিলেট এবং রাজশাহী বিভাগে চালু করা হয়। এছাড়াও কক্সবাজার, ফেনী, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, সাতক্ষীরা এবং সর্বশেষ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহরে সরাসরি এ সেবা চালু রয়েছে। ফোন করলেই বাসায় পোঁছে দেওয়া হচ্ছে সিলিন্ডার। যেসব জেলা শহরে সরাসরি সেবা নেই, সেখানে কুরিয়ারে বা অ্যাম্বুলেন্স সিলিন্ডার পাঠাচ্ছেন তারা। আর এ কাজে সারাদেশে সহায়তা করছেন ১৫০ জনের বেশি স্বেচ্ছাসেবক। 

বিনামূল্যে অক্সিজেন সেবা দিয়ে মানুষের হৃদয় কেড়েছেন ছাত্রলীগের তিন নেতা

দেশে করোনাভাইরাসের তৃতীয় ঢেউয়ে শনাক্ত রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। এতে অক্সিজেনের চাহিদাও বেড়েছে কয়েকগুণ। এ অবস্থায় অক্সিজেনের ব্যাপক চাহিদা বেড়েছে বলে জানান প্রধান উদ্যোক্তা সাদ বিন কাদের চৌধুরী। তিনি বলেন, আমরা যখন এই সেবা শুরু করেছিলাম, সেই সময়ের চেয়ে এখন কয়েকগুণ বেশি সিলিন্ডার প্রয়োজন হচ্ছে। প্রতিদিনই শুধুমাত্র ঢাকাতেই ১৫-২০ জনকে আমরা সেবা দিচ্ছি, যদিও চাহিদা আরও বেশি। তাছাড়া সবাই যথাসময়ে সিলিন্ডার জমা না দেওয়ায় আমরাও সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছি।

তিনি আরও বলেন, যেসব জেলায় সংক্রমণ বেশি আমরা সেসব জেলায় অক্সিজেন সেবা চালুর চেষ্টা করি। সেক্ষেত্রে যেসব জেলায় সংক্রমণ কমে গেছে সেসব জেলা থেকে আমরা অধিক সংক্রমিত জেলার দিকে মুভ করি।

সাদ বিন কাদের চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোভিড-১৯ পরিস্থিতির শুরু থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সারাদেশে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মানুষের পাশে থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন। নেত্রীর নির্দেশ বাস্তবায়নে সারাদেশে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন ধরনের জনবান্ধব কর্মসূচি নিয়ে মানুষের পাশে থেকেছে। সে ধারাবাহিকতায় মানুষের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিয়ে আমরা চালু করি বিনামূল্যে জয় বাংলা অক্সিজেন সেবা। আমাদের সেবাটি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। সেবার জন্য কোনো যাতায়াত ভাড়া নেই। এমনকি কোনো জামানতও জমা দিতে হয় না। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন থাকা সাপেক্ষে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এই সেবাটি আমরা মানুষের বাসায় পৌঁছে দেই।

মানুষের প্রতি ভালোবাসার টানেই এমন কার্যক্রম উল্লেখ করে তিনি বলেন, এত দীর্ঘসময় মানুষের ভালোবাসা ছাড়া এ ধরনের একটি সেবা পরিচালনা করা অসম্ভব। ভালোবাসার কোনো বিনিময় হয় না। মানুষের ভালোবাসায় জন্যই আমরা দীর্ঘ সময় এই কাজটি পরিচালনা করতে সম্ভব হয়েছি। মানুষ যখন বলে আমাদের অক্সিজেন সিলিন্ডারের উসিলায় উনি বেঁচে গেছেন, পুনরায় জীবন ফিরে পেয়েছেন তখন এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর হতে পারে না। যদিও হায়াতের মালিক সৃষ্টিকর্তা। এই মহামারিতে অনেকে তার প্রিয়জন হারিয়েছেন। হারানোর লাইনটা আর দীর্ঘতর না হোক সেটি প্রত্যাশা। মানুষের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিয়ে দিনে ২৪ ঘণ্টা এবং সপ্তাহে ৭ দিন সেবা অব্যাহত রেখেছি। সংকট যতদিন ততদিন আমরা এই সেবা নিয়ে মানুষের পাশে থাকব ইনশাল্লাহ।

আনন্দের পাশাপাশি আর্তনাদের সাক্ষীও হতে হয়েছে জানিয়ে সাদ বলেন, আনন্দ যেমন দেখেছি, ঠিক তেমনি আর্তনাদের সাক্ষীও হতে হয়েছে। অন্যের প্রিয়জন হারানোর বেদনা আমাদের ব্যথিত করেছে। অনেক সময় রোগীর চাপ এত বেশি থাকে যে সবাইকে আমরা অক্সিজেন সিলিন্ডার দিতে পারি না। এই সময় আমরা দোকান থেকে ভাড়া নিয়ে এবং ভাড়ার মূল্য পরিশোধ করে সেবা দিয়ে থাকি। কিন্তু কিছু সময় থাকে যখন তাদের কাছেও সিলিন্ডার থাকে না। তখন আমরা অতিরিক্ত এই রোগীদের আমাদের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অক্সিজেন সাপোর্ট দিতে পারি না। আমরা ব্যথিত হই। এই বিষয়টি আমাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টের।

নতুন ভোরের প্রত্যাশা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘একটি নতুন ভোরের প্রতীক্ষা’ স্লোগানকে সামনে রেখে আমরা সারাদেশে ধাপে ধাপে চালু করি বিনামূল্যে জয় বাংলা অক্সিজেন সেবা। আমরা বিশ্বাস করি করোনামুক্ত যে নতুন ভোরের স্বপ্ন আমরা দেখি সেই ভোর খুব বেশি দূরে নয়। দুঃখের অমানিশা ভেদ করে সুখের সোনালী সূর্য আবার ফিরে আসুক সেই প্রত্যাশা করি। এই অন্ধকারে আলো হয়ে মানুষের পাশে থাকবে জয় বাংলা অক্সিজেন সেবা।

আরেক উদ্যোক্তা ঢাবি ছাত্রলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম সবুজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা গত এক বছর ধরে কাজ করছি। প্রথমদিকের চেয়ে এখনকার অবস্থা কয়েকগুণ বেশি খারাপ। সে কারণে অক্সিজেনের চাহিদা বেড়ে গেছে। আমরা মানুষের শতভাগ চাহিদা পূরণ করতে না পারলেও সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। আশা করি, সবাই ঘরে থাকবে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবে।

সেবা নিতে কীভাবে যোগাযোগ করতে হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ০১৯১১-৮২১৮৮৪ (সাদ বিন কাদের চৌধুরী), ০১৭১১-১৭৩৪০৫ (সবুর খান কলিন্স) ও ০১৭২৫-৩৪৩০৩৮ (রফিকুল ইসলাম সবুজ) নম্বরে কল করে সমস্যার কথা জানালেন অক্সিজেন পৌঁছে যাবে। 

এইচআর/এইচকে