বিশ্ব মানচিত্রে এশিয়া অঞ্চলের অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠের নাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যার সোনালি ইতিহাসের ছায়া পড়ছে বাঙালি জাতির মুক্তির ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়ে। দেশের শিক্ষা, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বাতিঘর, মুক্তবুদ্ধি চর্চার প্রাণকেন্দ্র এবং গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধের লালনক্ষেত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আজ অতিক্রম করছে তার স্বর্ণালি ইতিহাসের শততম বর্ষ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন ঢাকা পোস্টের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক আমজাদ হোসেন হৃদয়

ঢাকা পোস্ট: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় অর্জন কোনটি?

উপাচার্য: বাংলাদেশ জাতি রাষ্ট্রের সৃষ্টি থেকে শুরু করে এই জাতির যা কিছু মহৎ অর্জন, যা কিছু গর্বের। সেটা ঐতিহাসিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক কিংবা বুদ্ধিবৃত্তিক এই সব উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বঙ্গবন্ধু কন্যা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। বঙ্গবন্ধুকে তো কারো সঙ্গে তুলনা করা যায় না, তিনি একবারেই স্বতন্ত্র। এই জাতির সামগ্রিক উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা যে অনবদ্য অবদান রাখছে, আজকে যে অবস্থানে আমরা পৌঁছেছি তা নিঃসন্দেহে গর্বের। এই দুজনের মধ্যে যে মূল্যবোধ, যে চেতনার জাগরণ ঘটেছে তার অবদান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের।

ঢাকা পোস্ট: কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করছে?

উপাচার্য: কোভিড-১৯ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হলেও অনলাইন ও অফলাইনের সমন্বয় আনার মাধ্যমে যাবতীয় শিক্ষা কার্যক্রম সচল রাখা হয়। শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাস ও অনলাইন/সশরীরে বিভিন্ন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে দীর্ঘমেয়াদের সেশনজটের ঝুঁকি রুখতে পারে। শিক্ষার্থীদের সেশনজটের ঝুঁকি নিরসনে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল প্রণীত ‘লস রিকোভারি প্ল্যান’ প্রণয়ন করা হয়। সিনেট, সিন্ডিকেট একাডেমিক কাউন্সিল, ফিন্যান্স কমিটি, একাডেমিক কমিটিসহ বিভিন্ন সংবিধিবদ্ধ বডির সভা নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সামগ্রিক ব্যবস্থাকে ডিজিটালাইজেশনের আওতায় আনতে 'লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম' গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

ঢাকা পোস্ট: শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কী কী উদ্যোগ হাতে নিয়েছে?

উপাচার্য: শতবর্ষকে সামনে রেখে 'টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব উপযোগী বিশ্ববিদ্যালয় বিনির্মাণ ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি’ শীর্ষক প্রতিপাদ্য ধারণ করে বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা পরিবেশ এবং অত্যাবশ্যক অবকাঠামোসহ সামগ্রিক উন্নয়নের ‘মাস্টার প্ল্যান' প্রণয়ন, মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণার তহবিল গঠন এবং গবেষণাগারের আধুনিকায়ন, মল চত্বরের ল্যান্ডস্কেপিংসহ ‘সেন্টিনারি মনুমেন্ট' তৈরি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশের ওপর মৌলিক গ্রন্থ প্রকাশ প্রভৃতি। শিক্ষকদের কাছ থেকে গবেষণা প্রকল্পের জন্য ২৫১টি গবেষণা প্রস্তাব, বিভাগ/ইনস্টিটিউট/সেন্টারসমূহ থেকে গ্রন্থ প্রকাশের জন্য ৪২টি গ্রন্থ এবং ২৮টি জার্নালের বিশেষ সংখ্যা প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে।

ঢাকা পোস্ট: বিশ্ব রাঙ্কিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবনমন হচ্ছে যার মূল কারণ গবেষণা, গবেষণায় বিশ্ববিদ্যালয় কেন এত পিছিয়ে?

উপাচার্য: রাঙ্কিংয় নির্ধারণের সূচকসমূহের বিশেষ করে মৌলিক গবেষণা এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাতের উন্নয়ন না ঘটলে বিশ্ব ব্যাংকিংয়ে আমাদের অবস্থান এগুনো তো দূরের কথা, পেছানো অস্বাভাবিক নয়। একটি তথ্য উপস্থাপন করি, কিউএস ওয়ার্ল্ড ব্যাংকিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৮০০-১০০০-এ; কিন্তু বিষয়ভিত্তিক 'বিজনেস অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট' স্টাডিজ ক্যাটাগরিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৩৫১-৪০০।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. হাসিনা খান ও অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রিয়াজুল ইসলাম এবং জিন প্রকৌশলী ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. আফতাব উদ্দিনের নেতৃত্বে একদল গবেষক, জীববিজ্ঞানী সোনালী আঁশ পাটের মধ্যে বসবাসরত একটি নতুন ব্যাকটেরিয়া থেকে জীবন রক্ষাকারী একটি এন্টিবায়োটিকের সন্ধান পেয়েছেন, যার নাম দেওয়া হয়েছে হোমিকরসিন। তাদের এই গবেষণাটি বিখ্যাত জার্নাল ন্যাচার পাবলিসিং গ্রুপের ‘সাইন্টিফিক রিপোর্ট’ জার্নালে গত ২৭ মে প্রকাশিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষে মৌলিক এ গবেষণা ও আবিষ্কার শতবর্ষী এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য, নিঃসন্দেহে গৌরবের।

ঢাকা পোস্ট: গ্র্যাজুয়েটদের দক্ষতা উন্নয়নে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে কিনা?

উপাচার্য: গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক ও প্রায়োগিক কর্মদক্ষতা, ভাষাদক্ষতা ও করপোরেট শিষ্টাচার জ্ঞান অর্জনসহ তাদের অধিকতর নিয়োগযোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য 'গ্র্যাজুয়েট প্রমোশন অ্যান্ড স্ক্রিল ডেভেলপমেন্ট নামক এক বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বাজারে নিজেদের মর্যাদাকর অবস্থান টিকিয়ে রাখা, এসডিজি অর্জনে ভূমিকা রাখতে সক্ষম দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির লক্ষ্যে এ কর্মসূচির আওতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ/ইনস্টিটিউট নিজ নিজ গ্র্যাজুয়েটদের স্বার্থে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আন্তঃসম্পর্ক ও আন্তঃসহযোগিতার জন্য সমঝোতা চুক্তি বা বিনিময় চুক্তি সম্পাদন করবে এবং গ্র্যাজুয়েটদের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ করবে।

ঢাকা পোস্ট: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শতবর্ষে এসেও পূর্ণাঙ্গ আবাসিক সুবিধা পায়নি, এই ব্যর্থতা কার?

উপাচার্য: আমরা এই নিয়ে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারপ্ল্যানের বড় অংশ জুড়ে আছে আবাসন সংকটের সমাধান। এর আওতায় শিক্ষার্থীদের জন্য ‘জয় বাংলা হল’ ও ‘শহীদ এথলেট সুলতানা কামাল হল’ নির্মাণসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। আশা করি এ সংকট আর থাকবে না।

ঢাকা পোস্ট: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে আপনি কী স্বপ্ন দেখেন?

উপাচার্য: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দ্বিতীয় শতবর্ষের উপযোগী বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখি।

এইচআর/এসএম