পোকামাকড়ের নাম শুনলেই আমরা ভয় পাই। যে কোনো পোকা দেখলেই তাৎক্ষণিক মেরে ফেলি। তবে আমাদের পরিবেশে বিচরণশীল সব পোকামাকড়ই ক্ষতিকর নয়। অনেক প্রজাতির পোকামাকড় আছে যারা পরাগায়ন ও ফসলের ক্ষতিকর পোকামাকড় ধ্বংসের মাধ্যমে আমাদের ফসল উৎপাদনে সহায়তা করে।

বর্তমানে চাষ করা মাছ বাংলাদেশের মানুষের প্রাণিজ আমিষের একটি বড় অংশ পূরণ করছে। বিগত দুই দশকে সারাবিশ্বে চাষকৃত মাছের উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। তবে চাষকৃত মাছের জন্য প্রচুর খাদ্যের প্রয়োজন। এসব মাছের খাদ্যের দাম তুলনামূলক বেশি হওয়ায় সাধারণ মাছচাষিদের পক্ষে প্রয়োজন অনুযায়ী সেই খাদ্য সরবরাহ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এছাড়া মাছের খাদ্যে ভেজালের ফলে একদিকে যেমন চাষিরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে বর্তমান বিশ্বে ও বাংলাদেশে উৎপাদিত খাদ্যের এক-তৃতীয়াংশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই খাদ্য বর্জ্য পচে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন এবং পরিবেশ দূষণ করছে। 

পোকা, বর্জ্য ও মাছ এই তিনটিকে সমন্বয় করে গবেষণায় সফল হয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একোয়াকালচার বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আব্দুস সালাম। তিনি ‘কালো সৈনিক পোকা’ বা ‘ব্ল্যাক সোলজার্স ফ্লাই’ নামক একটি পোকার ওপর ১০ বছর গবেষণা করে এ সফলতা পেয়েছেন। 

গবেষণায় দেখা গেছে, ময়লা-আবর্জনা, পচনশীল ফলমূল, শাক সবজি, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা এবং গৃহপালিত প্রাণীর মল ভক্ষণ করে পোকাটির লার্ভা। সেই লার্ভা মাছের বিকল্প খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হবে। 

গবেষকের দাবি, এই পোকা জৈব আবর্জনার ৭১ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত ভক্ষণ করে হজম করে থাকে। অবশিষ্ট অংশ বায়োডিজেল, প্রোটিন এবং কম্পোস্ট সারে রূপান্তরিত হয়।

শনিবার (১৩ নভেম্বর) বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের গ্যালারিতে আয়োজিত ‘মৎস্য খাদ্যের বিকল্প হিসেবে কালো সৈনিক পোকার চাষ ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক এক কর্মশালায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে গবেষণা সম্পর্কিত এসব তথ্য জানান প্রধান গবেষক অধ্যাপক ড. মো. আব্দুস সালাম।

গবেষক অধ্যাপক ড. মো. আব্দুস সালাম

গবেষণা সম্পর্কে তিনি বলেন, কালো সৈনিক পোকা পরিবেশবান্ধব এবং কৃষকের বন্ধু। শুষ্ক অবস্থায় এই পোকার লার্ভা থেকে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ আমিষ, ৩০ থেকে ৩৬ শতাংশ স্নেহ এবং ২০ থেকে ২২ শতাংশ শর্করা পাওয়া গেছে। এছাড়া পর্যাপ্ত পরিমাণে ফসফরাস, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও সোডিয়াম এই পোকার লার্ভাতে রয়েছে। গবেষণা চলাকালে আহরিত লার্ভা থেকে মাছের খাদ্য প্রস্তুত করে তেলাপিয়া মাছের ওপর গবেষণা করে বাজারে প্রাপ্ত বাণিজ্যিক খাদ্যের চেয়ে অনেক ভালো ফলাফল পাওয়া গেছে।

ড. মো. আব্দুস সালাম আরও বলেন, আমাদের চাষিরা কালো সৈনিক পোকার চাষ পদ্ধতি অবলম্বন করে কম খরচে মাছ এবং হাঁস-মুরগির খাদ্যের অনেকটাই যোগান দিতে পারেন। আর্থিক সাশ্রয়ের পাশাপাশি বাড়ির বর্জ্য পরিশোধন করে তারা গুণগত মানের সারও পেতে পারেন। তাছাড়া পোল্ট্রি বা ডেইরি ফার্মে কালো সৈনিক পোকার লার্ভা চাষ করে একদিকে প্রোটিন সমৃদ্ধ জীবন্ত খাদ্য পাওয়া যাবে, অপরদিকে ফার্মের বর্জ্য পরিশোধন করাও সম্ভব। চায়না, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকার মত উন্নত দেশসমূহ ক্যাটফিস, তেলাপিয়া ও হাঁস-মুরগির খাদ্য হিসেবে কালো সৈনিক পোকার লার্ভা ব্যবহার করে আশানুরূপ ফল পেয়েছে। আমাদের দেশের জলবায়ু কালো সৈনিক পোকার জন্য উপযোগী হওয়ায় এর ব্যাপক উৎপাদন সম্ভব। ফলে এর চাষের মাধ্যমে আমরাও কম খরচে মাছ এবং হাঁস-মুরগির ভেজালমুক্ত খাবার উৎপাদন করে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারি।

পোকাটির লার্ভা বাজারজাতকরণ সম্পর্কে গবেষক জানান, কালো সৈনিক পোকার লার্ভা মাছ চাষিদের মাঝে ইতোমধ্যে মাঠপর্যায়ে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পোকাটির লার্ভা কেজি প্রতি ৩ হাজার টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। তবে এটি ব্যাপক পরিমাণে উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ এখনও শুরু হয়নি। এক্ষেত্রে বিভিন্ন বাণিজ্যিক কোম্পানিগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান করা হচ্ছে।

কর্মশালায় মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মাহফুজুল হকের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাকৃবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসান। 

প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপাচার্য বলেন, সিটি শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য এই কালো সৈনিক পোকাটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। মাছের খাদ্যের পাশাপাশি মুরগি, হাঁস ও অন্যান্য গৃহপালিত পশু-পাখির বিকল্প খাদ্য হিসেবে স্বাস্থ্যসম্মত, পরিবেশবান্ধব ও সুলভ মূল্যের হতে পারে এই পোকার লার্ভা। এছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ দূষণ রোধে এটি পরোক্ষভাবে ভূমিকা পালন করতে পারে। আমরা সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এই গবেষণা সম্পর্কিত তথ্য- উপাত্তগুলো অবহিত করতে চাই।

আরএআর