নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী হল

আবাসিক হলে সাউন্ড বক্সে উচ্চস্বরে গান বাজিয়ে শিক্ষার্থীদের মারধর, দলীয়-সাধারণ শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের করে দেওয়া, নিজেদের ইচ্ছায় হলের ডাইনিং বন্ধ করাসহ বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল শাখা ছাত্রলীগ নেত্রীদের বিরুদ্ধে।

এছাড়া বিভিন্ন নেত্রীর জন্মদিনের পার্টি ও দলীয় মিছিল-মিটিংয়ে যেতে সাধারণ শিক্ষার্থীকে বাধ্য করাসহ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী হলের ছাত্রলীগ নেত্রীদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ ওঠে।

হলে অবস্থানকারী শিক্ষার্থীরা বলছেন, শাখা ছাত্রলীগের প্রশ্রয় এবং হল প্রশাসনের নির্লিপ্ততায় এসব করছেন তারা। ফলে দিনদিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন এসব নেত্রীরা।

সর্বশেষ গত শুক্রবার (১২ নভেম্বর) রাত সাড়ে ৯টার দিকে ছাত্রলীগ নেত্রী অর্পণা নাথ, জিনাত ইভাসহ ছাত্রলীগের বিভিন্ন নেতাকর্মীরা হলের টিভি রুমে উচ্চশব্দে গান বাজিয়ে ছাত্রলীগ কর্মী সিসিলি জামানের জন্মদিনের পার্টি করছিলেন। চূড়ান্ত পরীক্ষা থাকা সত্ত্বেও এসব পার্টিতে বিভিন্ন বিভাগের কনিষ্ঠ শিক্ষার্থীদের যেতে বাধ্য করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন তারা।

সে সময় কয়েকজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিনিধি ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ছাত্রী জান্নাতুল ফেরদৌসকে বিষয়টি জানালে তিনি সেখানে গিয়ে উচ্চশব্দে গান না বাজানোর অনুরোধ করেন।

এ সময় তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে উল্টো গানের শব্দ আরও বাড়িয়ে দেন ছাত্রলীগ নেত্রী অর্পণা নাথ। বিষয়টি হল প্রাধ্যক্ষকে জানানো হলে কিছুক্ষণ পর গান বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ ঘটনার পর হলে অবস্থানকারী কনিষ্ঠ শিক্ষার্থীদের দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেসবুক গ্রুপে ঘটনার পক্ষে সাফাই গেয়ে জোরপূর্বক পোস্ট করানো হয়।

এ ঘটনা ছাড়াও হলের ডাইনিং নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যখন-তখন সাধারণ শিক্ষার্থীদের মিল বন্ধ করার অভিযোগও উঠেছে এসব নেত্রীদের বিরুদ্ধে।

হলে অবস্থানকারী একাধিক ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী অভিযোগ করে বলেন, অনেকেরই এখন পরীক্ষা চলছে, এ সময় বাইরে গিয়ে খাওয়া সম্ভব না। হলের ডাইনিংয়ের খাবারের মান নিয়ে কথা বলায় মান ভালো না করে উল্টো ডাইনিংই বন্ধ করে দিয়েছেন হল ছাত্রলীগের নেত্রীরা।

এর আগে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ছাত্রলীগ নেত্রী ইসরাত জাহান জেরিন, অর্পণা নাথসহ কয়েকজন সে সময়কার ডাইনিং ম্যানেজার লিপি আক্তারকে রুমে নিয়ে সাউন্ডবক্সে উচ্চস্বরে গান বাজিয়ে মারধর করে যেন মারধরের শব্দ বাইরে না যায়। সে ঘটনায়ও শাখা ছাত্রলীগ কিংবা হল প্রশাসনকে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।

এদিকে ছাত্রী হলে রাত ৯টার পর প্রবেশ ও বের হওয়া নিয়ে প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা থাকলে ছাত্রলীগ পরিচয়ে এসব নেত্রীরা নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই গভীর রাত পর্যন্ত হল থেকে বের হওয়া ও প্রবেশ করার অভিযোগ রয়েছে।

তাছাড়া বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীদের হল ছাড়া করার হুমকি দেওয়ার পাশাপাশি নৃবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষার্থীকে হল থেকে নামিয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে এই নেত্রীদের বিরুদ্ধে। হল ছাত্রলীগের নেত্রীদের এমন কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ বিরাজ করছেন সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, হলকে তারা (ছাত্রলীগ নেত্রীরা) নিজেদের বাপ-দাদার সম্পত্তি মনে করে যাচ্ছেতাই করছে। (ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে থাকা) ডাইনিংয়ের খাবার, ছাত্রলীগ নেত্রীদের কোনো অনিয়ম নিয়ে কথা বললেই শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের খড়গ নেমে আসে এবং হল ছাড়ার হুমকি দেওয়া হয়।

এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে অভিযুক্ত অপর্ণা নাথ বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে আনা এসব অভিযোগ সত্য নয়। এইরকম অভিযোগ অনেকেই করে থাকে। দুইজনের জন্মদিন ছিল। জুনিয়ররা আমাকে এসে নিয়ে গেলে সেখানে ১৫ মিনিটের মতো গান বাজানো হয়েছে। 

অপর্ণা নাথ আরও বলেন, তবে একজন এসে অভিযোগ করলে তার কথাবার্তার অ্যাপ্রোচ ভালো ছিল না বলে তাকে বের হয়ে যেতে বলেছি। আমরা কাউকে দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করাইনি। দুইটা পোস্ট আসছিল এবং তা সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

ডাইনিংয়ে মিল বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে অপর্ণা নাথ বলেন, ‘আমরা এটি প্রশাসনকে (হল প্রাধ্যক্ষ) জানিয়েছি। স্যার বলছেন, যতদিন স্যার আসবে না ততদিন অফ থাকবে। আমরা স্যারকে বলছি স্যার আপনি আসেন আমরা কথা বলবো।’

তবে নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী হলের প্রাধ্যক্ষ মো. সাদেকুজ্জামান বলেন, ‘ডাইনিং বন্ধ করার বিষয়ে আমি কোনো নির্দেশ দেইনি। যারা ডাইনিং মেইনটেইন করে তারা আমার সঙ্গে ডাইনিং বিষয় নিয়ে কথা বলবে বলে জানিয়েছে।’

হল প্রশাসন ডাইনিং বন্ধের কোনো নির্দেশনা দেয়নি জানিয়ে অর্পণা নাথকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করা হলে আগের বক্তব্যটি অস্বীকার করে তিনি বলেন, প্রশাসন বন্ধ করেছে আমি এমন কথা বলিনি। আমি বলেছি ম্যানেজাররা দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে না, তাই এক সপ্তাহের জন্য ম্যানেজাররা ডাইনিং বন্ধ করে দিয়েছে।

উচ্চস্বরে গান বাজানোর বিষয়ে মো. সাদেকুজ্জামান বলেন, উচ্চস্বরে গান বাজানো নিয়ে আগে কখনো এইরকম অভিযোগ আসেনি। অভিযোগের বিষয়ে আমরা দুইপক্ষের সাথে কথা বলব। কেউ বার্থডে সেলিব্রেশন করলে বাধা দেওয়া যায় না। তবে নিয়মের মধ্য থেকেই করতে হয়।

নির্দিষ্ট সময়ের হলে প্রবেশ ও বের হওয়ার বিষয়ে সাদেকুজ্জামান বলেন, হলে প্রবেশের ক্ষেত্রে রাত ১০টার পর কাউকেই অ্যালাউ করা হয় না। কেউ বের হয়ে থাকলে ব্যক্তিগত জায়গা থেকে বের হয়ে থাকে। তবে যদি কেউ লেট করে প্রবেশ করে, তাহলে অবশ্যই তাকে যৌক্তিক কারণ দর্শাতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজ বলেন, গতকালের বিষয়ে অভিযোগ করার পর আমি ও প্রভোস্ট স্যার নির্দেশ দিলে তারা বন্ধ করে দেয়। তবে পরীক্ষার সময় উচ্চস্বরে গান বাজানো ঠিক হয়নি। আবার যদি এরকম করে তাহলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

রাতে নেত্রীদের বের হওয়ার বিষয়ে ইলিয়াস হোসেন বলেন, রাতে আমাদের কোনো সাংগঠনিক কাজে তাদের ডাকা হয় না। যারা বাহিরে যায় তারা ব্যক্তিগত কাজে যায়, দলীয় পরিচয় ব্যবহার করে বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নাই। আর এসব বিষয় হল প্রশাসন দেখবে।

এ সব বিষয়ে রেজিস্ট্রার ( অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. আবু তাহের বলেন, এ বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য আমরা হল প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলব, যাতে হলে সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় থাকে।

এমএসআর