ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি আবাসিক হলে ছাত্রলীগের কমিটি হচ্ছে না দীর্ঘ চার বছর ধরে। নানা সময়ে নানা অজুহাতে পেছানো হয়েছে কমিটি ঘোষণার সময়। চার বছর পেরিয়ে গেলেও কেন্দ্রীয় নেতাদের টনক নড়ছে না; টনক নড়েছে না ঢাবি ছাত্রলীগ নেতাদেরও।

হলগুলোতে ছাত্রলীগের সবশেষ কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করা হয় ২০১৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর। সে হিসেবে ওই কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে। কিন্তু এখন পর্যন্ত নতুন করে আর হল কমিটি দেওয়া হয়নি।

এরপর ছাত্রলীগে ঘটে গেছে অনেক ঘটনা। ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পাশাপাশি ঘোষণা করা হয় ঢাবি ছাত্রলীগের কমিটিও। সেখানে সভাপতি হন সনজিত চন্দ্র দাস আর সাধারণ সম্পাদক হন সাদ্দাম হোসেন।

তারা দায়িত্ব নেওয়ার কিছুদিন পর থেকেই ক্যাম্পাসে শুরু হয় ডাকসু নির্বাচনের তোড়জোড়। তখন হলে ছাত্রলীগ দুই ভাগে বিভক্ত হয় । এক ভাগ সাধারণ ছাত্রলীগ, অন্যরা ডাকসু ছাত্রলীগ। এর কিছুদিন পর ঢাবি ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, সেই কমিটির মেয়াদও শেষ হয়েছে দেড় বছর আগে; সনজিত-সাদ্দাম নিজেরাই মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছেন।

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে পদচ্যুত হন সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজোয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী। শোভন-রাব্বানীর অব্যাহতির কিছুদিন পর অসুস্থ হয়ে পড়েন সাদ্দাম। এদিকে ক্যাম্পাসেও রাজনীতির নানা সমীকরণ। ছাত্র অধিকার পরিষদ, ছাত্রদল আর বাম সংগঠনের সঙ্গে হাতাহাতিতে সময় কেটে গেছে অনেকটাই। 

ভারপ্রাপ্ত হয়ে ২০১৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো হল কমিটি দেওয়ার ঘোষণা দেন কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়। ডিসেম্বরে একই ঘোষণা আসে ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দামের মুখ থেকেও। পরের বছর ২০২০ সালের ৪ জানুয়ারি ভারমুক্ত হন জয়-লেখক। এরপর ৪ ফেব্রুয়ারি জয় জানান, প্রথমে তিন কার্যদিবসের মধ্যে হল কমিটি এবং পরে ২৮ মার্চ হল সম্মেলন হবে। তখন সাদ্দামও অভিন্ন সুর তোলেন। 

এসময় দেশে করোনা শনাক্তের খবরে বন্ধ হয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়। করোনা পরিস্থিতিতে নেতারা জানিয়েছিলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় খুললে’ দ্রুত হল সম্মেলন দেওয়া হবে। তবে গত বছল অক্টোবরে হল খুলে দেওয়া হলেও এখনও সম্মেলন হয়নি।

সনজিত-সাদ্দামের পাশাপাশি সম্মেলন না হওয়ার ‘দায়’ রয়েছে জয়-লেখকেরও। কেননা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল কমিটিতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের দুই শীর্ষ নেতাও পদের ‘ভাগ’ পান। তা ছাড়া, কেন্দ্রীয় দুই শীর্ষ নেতার অনুমোদন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল কমিটি ঘোষণার অলিখিত রীতি রয়েছে।
 
এদিকে, সম্মেলন না হওয়ায় ধীরে ধীরে রাজনীতি-বিমুখ হয়েছেন পদপ্রত্যাশীরা। ছাত্রীহলের বেশ কয়েকজন প্রার্থী এরই মধ্যে বিয়ে সেরেছেন (ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রে বিবাহিতদের পদ পাওয়ার সুযোগ নেই)। কেউ রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছেন। ছেলেদের হলেও একই দশা। কেউ মন দিয়েছেন পড়াশোনায়, কেউ ছেড়েছেন রাজনীতি। তবে এখনো অনেকেই চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছেন শেষটা দেখার অপেক্ষায়।

অক্টোবরের শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হিসেবে বিদেশে যান কেন্দ্রীয় ও ঢাবি ছাত্রলীগের শীর্ষ চার নেতা। সেই সফরের আগে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সনজিত-সাদ্দাম জানান, ২৮ নভেম্বর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হল সম্মেলন শুরু হবে। এতে পদপ্রত্যাশী নেতাকর্মীদের মাঝে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। কিন্তু সনজিতের শরীরে একটি অস্ত্রোপচারের কারণে ২৮ নভেম্বর হয়নি হল সম্মেলন।

এদিকে, নেতাকর্মীদের ‘মন রক্ষায়’ গত বছরের ২৮ নভেম্বর থেকে জীবনবৃত্তান্ত আহ্বান করা হয়। ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলা এ কর্মসূচিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য ৩৩০ জন শিক্ষার্থী জীবনবৃত্তান্ত জমা দেন। 

৩ ও ৪ ডিসেম্বর জীবনবৃত্তান্তগুলো যাচাই-বাছাই করা হয়। পরে জমা দেন আরও কয়েকজন। সম্মেলন করতে না পারার ব্যর্থতা ঢাকতে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে হল কমিটি করার আশ্বাস দেন সাদ্দাম। তবে এ আশ্বাসের বাস্তবায়ন হয়নি।  

ছাত্রলীগ সূত্রে জানা গেছে, জীবনবৃত্তান্ত যাচাই-বাছাই শেষে গত ৮ ডিসেম্বর রাতে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক দায়িত্বে থাকা আওয়ামী লীগের চার জ্যেষ্ঠ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ও বি এম মোজাম্মেল হকের সঙ্গে লেখক ভট্টাচার্য ছাড়া ছাত্রলীগের বাকি তিন শীর্ষ নেতার বৈঠক হয়। সেখানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও উপস্থিত ছিলেন। সেই বৈঠকে ২৩ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল সম্মেলন আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়।

বৈঠক শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগকে হল সম্মেলনবিষয়ক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশে নিষেধ করা হয়। বলা হয়, হল সম্মেলনের বিষয়টি নিয়ে তারা (আল নাহিয়ান ও লেখক) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলবেন।

দুই দফায় কমিটি গঠনের জন্য হল সম্মেলনের তারিখ ঠিক করা হলেও শেষ পর্যন্ত তা পরিণতি পায়নি। এখন বলা হচ্ছে, জানুয়ারিতে হল সম্মেলন হবে। এ নিয়েও তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। নেতা-কর্মীদের ভাষ্য, চলমান পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার নেপথ্যে রয়েছে সংগঠনের কেন্দ্রীয় সংসদ ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার চার শীর্ষ নেতার ‘প্রটোকল ও পদ হারানোর ভয়’।

প্রতিটি হলে এখন ছাত্রলীগেরই অঞ্চলভিত্তিক ৮-১০টি করে পক্ষ তৈরি হয়েছে। এতে নেতৃত্বের জট ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। নিয়ন্ত্রণ না থাকায় নেতাকর্মীদের কেউ কেউ বেপরোয়া হয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনেও জড়িয়ে পড়ছেন। এখনো হল কমিটি না হওয়ার কারণ হিসেবে নেতাকর্মীরা আরও বলছেন, শীর্ষ নেতাদের মধ্যে এমন ধারণা আছে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল সম্মেলন হয়ে গেলে তাদের কমিটিও ভেঙে দেওয়া হতে পারে!
 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলের মধ্যে অন্তত ১০টি হলের পদপ্রত্যাশীদের সাথে কথা হয়েছে ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকের। তারা জানিয়েছেন, হল কমিটিতে পদ পেতে অনেকেই ড্রপ (ইয়ার লস) দিয়েছেন। লম্বা সময় ধরে প্রটোকলও দিয়ে যাচ্ছেন নেতাদের। হল সম্মেলন নিয়ে এমন কানামাছি খেলায় তারা বেশ হতাশ। বিশেষ করে চলতি বছর কয়েকবার সম্মেলনের আশ্বাস পেয়েও শেষ পর্যন্ত আশার প্রদীপ জ্বলেনি।

এছাড়া, ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আসার ক্ষেত্রে বয়সসীমাও নির্ধারিত। যা পার হয়ে যাচ্ছেন বর্তমান পদপ্রত্যাশীরা। বয়সসীমার কারণে আগামীতে এসব সম্মেলন পান কি না সে শঙ্কায় আছেন তারা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের শীর্ষ পদপ্রত্যাশী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমাদের ভাগ্যটা খারাপ, ভবিষ্যৎ চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। রাজনীতির কারণে পড়ালেখাটাও ঠিকঠাক করা হয়নি। অন্তত এ সময় হলেও কমিটিটা দ্রুত দিয়ে দিলে নিজের গন্তব্যটা ঠিক করতে পারি।’

আরেক পদপ্রত্যাশী বলেন, ‘ছাত্রলীগের শীর্ষ চার নেতা চাইলে যেকোনো সময় কমিটি দিতে পারেন, কিন্তু আমাদের কথা কেউ ভাবছেন না। আমাদের ক্যারিয়ার নষ্টের পাশাপাশি ধ্বংস করা হচ্ছে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব। এটি ছাত্রলীগের জন্য অশনিসংকেত।’

শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ছাত্রলীগের সভাপতি সোহানুর রহমান বলেন, ‘দুই বছর আগে সাবেক লিখে ভিজিটিং কার্ড করেছিলাম। কিন্তু এখন পর্যন্ত সাবেক হতে পারলাম না। আমি হল সভাপতির পদ থেকে সাবেক হতে চাই। তাই দ্রুত সম্মেলনের ব্যবস্থা করা হোক।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ছাত্রীহলের এক নেত্রী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এভাবে ছাত্রলীগ চলতে পারে না। আমার যেমন ক্যারিয়ার আছে, হল কমিটির পদপ্রত্যাশীদেরও তো আছে। তাদের (শীর্ষ নেতৃত্ব) কোনো অধিকার নেই এ নেতাকর্মীদের ক্যারিয়ার ধ্বংস করার।’ 

হল কমিটির স্থবিরতায় ক্ষেপেছেন কেন্দ্রীয় নেতারাও। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের একাধিক নেতা জানান, ‘ব্যক্তি স্বার্থ রক্ষায় হল কমিটি হচ্ছে না। আটকে আছে বিশ্ববিদ্যালয় ও কেন্দ্রীয় কমিটিও। কেন্দ্রীয় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক আশঙ্কা করছেন, হল সম্মেলন ও কমিটি হয়ে গেলে কেন্দ্রীয় সম্মেলন দেওয়ার জন্য চাপ বেড়ে যাবে।’

ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সোহান খান বলেন, ‘ছাত্রলীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদে থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন এবং তারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে অনেক দূরে। কোনকিছুই তারা সঠিকভাবে করতে পারছেন না। পরিকল্পিতভাবে শীর্ষ নেতাদের ব্যক্তিগত স্বার্থরক্ষার জন্য ছাত্রলীগ ধ্বংসের পাঁয়তারা চলছে। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ক্যারিয়ার নষ্ট করার অধিকার কারো নেই।’

ছাত্রলীগের উপ-প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক মেশকাত হোসেন বলেন, ‘অনেক পদপ্রত্যাশীর চোখের পানি আমি দেখেছি, তাদের ক্যারিয়ার নিয়ে তামাশা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ও ঢাবির শীর্ষ চার নেতার সমন্বয়হীনতার কারণেই আজ এ অবস্থা। তারা সম্মেলন করতে না পারলে অন্তত প্রেস রিলিজের মাধ্যমে কমিটি দিয়ে দিক।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা সবাই আন্তরিকভাবে এ নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছি। মূলত দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস বন্ধ থাকার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল কমিটি করা সম্ভব হয়নি। আমরা প্রত্যাশা করছি, জানুয়ারির মধ্যেই হল সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব আসবে।’

এ বিষয়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমাদের কোনো স্বার্থের বিষয় এখানে জড়িত নয়। একটা নির্দিষ্ট কারণেই ২৮ নভেম্বর হল সম্মেলন হয়নি। ডিসেম্বর মাসে অনেকগুলো জাতীয় প্রোগ্রাম ছিল। সেজন্য আমরা চেয়েছি ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর পরেই হল সম্মেলন হোক।’

হল সম্মেলনের বিষয়ে ছাত্রলীগের দেখভালের দায়িত্বে থাকা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘গড়িমসি একটু আছে, ঠিক হয়ে যাবে। আমরা বসে ঠিক করে দেব। সম্মেলন ও কমিটি হয়ে যাবে। নেতৃত্বে সংকট তৈরি হবে না।’

এইচআর/আরএইচ