সবাই তাকে চেনেন বই খালেক নামে। পুরো নাম আব্দুল খালেক। বরিশাল নগরীর অলিগলি, হাসপাতাল, স্কুল কলেজের সামনে প্রায়শই চোখে পড়ে শিশুদের বই ফেরি করে বিক্রি করছেন তিনি। আদর্শলিপি, প্রাণী, পশু, সরিসৃপ, উভচর, মাছ, পাখি ইত্যাকার পরিচিতিমূলক বই নিয়ে প্রতিদিনকার যাত্রা। কোনোদিন চারশ আবার ভালো বিক্রি হলে দেড় হাজার টাকারও বই বিক্রি করতে পারেন আব্দুল খালেক। 

বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার পাদ্রিশিবপুর ইউনিয়নে বাড়ি হলেও এখন থাকেন নগরীর নথুল্লাবাদ এলাকায় একটি ভাড়া বাসায়। দুই ছেলে ও দুই মেয়ে তার। ছেলে দুটি সরকারি চাকরি করেন। ফলে তার বই বিক্রি করার প্রয়োজন হয় না। অকপটে তা স্বীকার করে তিনি বলেন, আমি কাজের মাধ্যমে বেঁচে থাকতে চাই। আর সেটা যদি হয় বই ফেরি করে বিক্রি করা, তাহলে তো কথাই নেই।

কীভাবে শুরু করলেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন বলেন, প্রায় ৪৫ বছর আগে বরিশাল শহরে ফেরি করে বই বিক্রি শুরু করি। তখন অবশ্য সংসারের প্রয়োজনেই এ ব্যবসা করতাম। ছেলে-মেয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বই বিক্রি বন্ধ করতে পারতাম। ছেলেমেয়েরা সেই কথাও বলেছিল। আমি তাতে রাজি হইনি। এখন যে বাজার দর আর বই থেকে মানুষ যেভাবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সেই বিবেচনায় বই বিক্রি বন্ধ করে দেওয়ারই কথা। কিন্তু আমার লক্ষ্য ভিন্ন।

আব্দুল খালেক বলেন, আমি জাতিকে শিক্ষিত করতে চাই। এ জন্যই জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও এখনো বই বিক্রি করছি। যেদিন ৪-৫শ টাকার বই বিক্রি করি সেদিন এক থেকে দেড়শ টাকা লাভ হয়। আবার যেদিন দেড় হাজার টাকার বিক্রি হয় সেদিন ৫-৬শ’ টাকা লাভ হয়। বর্তমান বাজারে এই লাভের টাকায় সংসার চলে না তা সবাই বোঝে। আমার কাছে ১৫ থেকে ২০ টাকায় রঙিন বই পাওয়া যায়।

বই খালেক দাবি করেন, বরিশাল শহরে এখন আমিই একমাত্র বইয়ের ফেরিওয়ালা। আসলে এই কাজটি আমার ভালো লাগে। অনেকে ব্যবসায়ী পণ্য বিক্রি করে অনেক টাকার মালিক হয়েছেন, তাতে দেশের কোনো লাভ হয়নি। কিন্তু একটি শিশুর প্রথম শিক্ষাটি যখন আমার কাছ থেকে ক্রয় করা বইয়ের মাধ্যমে শুরু হয়, তখন নিজের কাছে তৃপ্তি লাগে। আমার সন্তুষ্টির জায়গা ফেরিওয়ালা জীবনের ৪৫ বছরে লাখো শিশু আমার কাছ থেকে বই কিনে শিক্ষা জীবন শুরু করেছে। হয়তো তারা অনেক বড় হয়েছে! বই বিক্রি করে আমি সম্পদ গড়তে পারিনি, তবে আত্মতৃপ্তি আছে।

বুধবার (২ মার্চ) শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রধান ফটকের সামনে আলাপ হয় তানিয়া আক্তার নামে এক গৃহবধূর সাথে। ৬টি বই ক্রয়ের জন্য দরদাম করছিলেন তিনি। তানিয়া আক্তার বলেন, খালেক চাচার কাছ থেকে আগেও বই কিনেছি। আজ বোনের ছেলের জন্য কিনছি। তাকে এর আগে খুঁজেছি, কিন্তু পাচ্ছিলাম না। শিশুদের বই ফেরিওয়ালা আমি যতদূর দেখেছি তাকেই। কারণ শহরের বিভিন্ন স্থানে তাকে ঘুরে ঘুরে বই বিক্রি করতে দেখেছি।

সি অ্যান্ড বি রোড চৌমাথা এলাকায় কথা হয় কলেজের শিক্ষক মিজানুর রহমানের সাথে। তিনি বলেন, বই খালেক নামে আমরা তাকে চিনি। কয়েকবার তার কাছ থেকে বই কিনেছি। বাইরের দিক থেকে দেখে মনে হয় অন্য দশটি পেশার মতোই তিনি ব্যবসা করছেন। কিন্তু একটু ভাবলে দেখবেন, তথ্য-প্রযুক্তির এই সময়ে যখন সব কিছু পিডিএফমুখী, তখনো তিনি কাগজের বই আর আদর্শলিপি বিক্রি করছেন। আব্দুল খালেক সমাজের জন্য খুব ভালো  একটি কাজ করে চলেছেন।

সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরআই