তাদের পরিচয়ে এখন পরিচিত সদ্যপুষ্কুরিনী
রংপুর সদর উপজেলার সদ্যপুষ্কুরিনী ইউনিয়ন। শহর থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই ইউনিয়নে ফুটবল দিন দিন পাচ্ছে জনপ্রিয়তা। আর সেই জনপ্রিয়তা আসছে এখানকার ফুটবলকন্যাদের হাত ধরে। এক অজপাড়াগাঁ থেকে জাতীয় নারী ফুটবল দলসহ অনূর্ধ্বভিত্তিক দল ও বিভিন্ন ক্লাবে এ পর্যন্ত খেলছে ১৪ জন। দেশ-বিদেশে ভালো খেলে সুনামও কুড়িয়েছে তারা। নিজেদের পরিচয় মেলে ধরার স্বপ্ন অর্জনে রেখেছে কৃতিত্বের স্বাক্ষর। তাদের ফুটবল ম্যাজিকে সদ্যপুষ্কুরিনী এখন নারী ফুটবলারদের এলাকা হিসেবে পরিচিত।
অর্থনৈতিক-সামাজিক নানা প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে ঝিমিয়ে পড়া ফুটবল অঙ্গনকে জাগরিত করেছে সদ্যপুষ্কুরিনী যুব স্পোর্টিং ক্লাবের মেয়েরা। মাঠে বরাবরই চমকপ্রদ ফুটবল খেলে নিজেদের শক্তি সামর্থ্যের জানানও দিয়েছে তারা। এখানকার অদম্য ফুটবলকন্যারা বিভিন্ন সময়ে পেশাদার ফুটবল লিগসহ বয়সভিত্তিক বিভিন্ন টুর্নামেন্ট খেলছে।
বিজ্ঞাপন
২০১৯-২০২০ নারী ফুটবল লিগে এফসি উত্তরবঙ্গের হয়ে খেলেছে সদ্যপুষ্কুরিনী যুব স্পোর্টিং ক্লাবের ১৪ জন খেলোয়াড়। এবার আসন্ন বাংলাদেশ নারী ফুটবল লিগে অন্য কারও হয়ে নয়, নিজ ক্লাবের হয়ে মাঠে ম্যাজিক দেখাতে চান সদ্যপুষ্কুরিনীর মেয়েরা। খেলতে চান নিজেদের ক্লাবের জার্সি গায়ে জড়িয়ে। এ জন্য অধীর আগ্রহ আর কঠোর অনুশীলনের সঙ্গে নানা প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলার চেষ্টা চলছে।
সদ্যপুষ্কুরিনী যুব স্পোর্টিং ক্লাবের জার্সি পড়ে মাঠে নামার স্বপ্নে বিভোর অদম্য ফুটবলকন্যারা মুখিয়ে আছে ক্লাব থেকে খেলতে। নিজ ক্লাবের হয়ে খেলতে পারলে চ্যাম্পিয়নের খেতাব ছিনিয়ে আনতে সর্বোচ্চটা দিয়ে লড়ে যাবে তারা।
বিজ্ঞাপন
সোমবার (৮ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে পালিচড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পালিচড়া এমএন উচ্চবিদ্যালয়ের সামনের মাঠে অনুশীলন করতে দেখা যায় সদ্যপুষ্কুরিনী যুব স্পোর্টিং ক্লাবের মেয়েদের। সেখানে তাদের সঙ্গে ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকের আলাপনে উঠে আসে বাংলাদেশ নারী ফুটবল লিগে এখানকার মেয়েদের নিজ ক্লাবের হয়ে খেলার আগ্রহের কথা।
ভোরে কিংবা বিকেলে ছোট ছোট দল বেঁধে মাঠে আসে ওরা। গায়ে রঙিন জার্সি। হাতে ফুটবল। চলে কঠোর অনুশীলন। লক্ষ্য লাল-সবুজের পতাকাবাহী দলে জায়গা করে নেওয়া। সঙ্গে নিজেদের ক্লাবের প্রতিনিধিত্বটাও করা। ওরা পরিচয়ে নারী হলেও নিজেদের মানুষ ভেবে সামনে এগিয়ে যেতে চায়। এ কারণে অবহেলা, দারিদ্র্যতা বা সমাজের চোখ রাঙানি কিছুই দমাতে পারেনি ওদের। বরং অর্থনৈতিক-সামাজিক নানা প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে ওরা ছুটছে ফুটবলকে সামনে রেখে।
প্রায় ৩০ জনের কিশোরী ফুটবল দলের অনেকেই ভালো খেলে দেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুনাম কুড়িয়েছে। নিজেদের পরিচয় মেলে ধরার স্বপ্ন অর্জনে রেখেছে কৃতিত্বের স্বাক্ষর। অজপাড়াগাঁ থেকে উঠে আসা এই অদম্য ফুটবলকন্যাদের কারণে গ্রামে যেমন তৈরি হয়েছে সচেতনতা, তেমনি বেড়েছে ফুটবলের প্রতি সবার আগ্রহ। এই ইউনিয়নে এখন আগের মতো বাল্যবিয়ের হিড়িক নেই। বরং গ্রামের সবাই মিলে সদ্যপুষ্কুরিনী যুব স্পোর্টিং ক্লাবের মাধ্যমে ফুটবল অঙ্গনকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।
এফসি উত্তরবঙ্গের হয়ে সদ্যপুষ্কুরিনী যুব স্পোটিং ক্লাব থেকে খেলা রুনা আখতার ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত বছর আমাদের অনেকেই এফসি উত্তরবঙ্গের হয়ে খেলেছে। আমরা ভালো খেলেছি, কিন্তু নাম হয়েছে অন্যদের। এ জন্য আমাদের সবার ইচ্ছা এবারের বাংলাদেশ নারী ফুটবল লিগে সদ্যপুষ্কুরিনী স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে খেলা। এটা আমাদের নিজেদের
এই ক্লাবের হয়ে খেলতে পারলে লিগে সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য। আমরা আমাদের নিজ পরিচয়ে এগিয়ে যেতে চাই। রংপুর জেলাকে, আমাদের গ্রামকে সবার কাছে তুলে ধরতে চাই।
রুনা আখতার, খেলোয়াড়
সদ্যপুষ্কুরিনী ক্লাবের মেয়ে ময়ূরী আখতার। দেশে ও দেশের বাহিরে বয়সভিত্তিক বিভিন্ন দলে খেলেছেন। এই ফুটবলকন্যা ঢাকা পোস্টকে জানান, ২০১১ সালে প্রথম বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের মধ্য দিয়ে এ গ্রামের ৪০ জন ক্ষুদে কিশোরী ফুটবল খেলা শুরু করে। ওই বছরই পালিচড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নারী ফুটবলাররা রংপুর বিভাগের হয়ে নেতৃত্ব দিয়ে রানার্স আপ হয়। পরের বছরই দেশসেরা ফুটবল দল হয় তারা। এর পর থেকে শুধু সাফল্যই এসেছে। কখনো চ্যাম্পিয়ন নয়তো রানার আপ। জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের পাশাপাশি সারাদেশের মধ্যেও ওরা বরাবরই সেরা ছিল। ভালো খেলোয়াড় থাকায় সদ্যপুষ্কুরিনী থেকে অনেকেই জাতীয় দলে এবং বয়সভিত্তিক দলের পাশাপাশি ক্লাবগুলোতে খেলার সুযোগ পেয়েছে। এ কারণে এবার তারা নিজেদের ক্লাবের পরিচয়ে খেলতে চান।
আরেক খুদে ফুটবলার নাসরিন আখতার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে খেলি। আমাদের অনেক সাফল্য রয়েছে। ২০১৯ সালে আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। কিন্তু এবার আমাদের ইচ্ছা নিজেদের ক্লাবের হয়ে খেলা। নিজেদের ক্লাবের জার্সি ও পরিচয়ে ক্লাবের প্রতিনিধিত্ব করতে চাই। দেশের এক নম্বর ক্লাব হতে চাই আমরা।
সদ্যপুষ্কুরিনী যুব স্পোর্টিং ক্লাবের অনেকেই দেশের হয়ে তাজিকিস্তান, ভুটান, ভারতে খেলেছেন। তাজিকিস্তানে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ ফুটবল প্রতিযোগিতায় চূড়ান্ত পর্বে ভারতকে ৯-০ গোলে হারিয়ে সেবার বাংলাদেশ শিরোপা জয়ী হয়েছিল। ওই দলে তিন ফুটবলার লাবণী আক্তার, আর্শিতা জাহান ও আঁখি আক্তার খেলেছেন।
সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ চ্যাম্পিয়ন ও এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপে কৃতিত্বের জন্য গ্রামের সুলতানা, লাভলী, রত্নাসহ বেশ কয়েকজন প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আর্থিক সম্মাননা পুরস্কার পেয়েছে। এরপর থেকে গ্রামের অনেক মেয়ে ফুটবলে আসতে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। এখানকার স্বপ্না, রত্না, মৌসুমি, রুনা, রুমি, সুলতানা, বৃষ্টি, লাবণী, মৌরসী, আশা অনূর্ধ্ব-১৬, অনূর্ধ্ব-১৫ ও অনূর্ধ্ব-১৪ দলের হয়ে খেলেছে।
অভাব-অনটনের সংসার থেকে উঠে আসা এসব ফুটবলকন্যাদের দমাতে পারেনি অবহেলা, দারিদ্র্যতা বা সমাজের চোখরাঙানি। বরং অর্থনৈতিক-সামাজিক নানা প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে ওরা ছুটছে ফুটবলকে সামনে রেখে। তাদের স্বপ্নটাকে এবার বাস্তবে রূপ দিতে চান ক্লাবের উপদেষ্টা ও ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কামাল হোসেন।
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানকার নারী ফুটবলারদের অনেক সুনাম রয়েছে। এখানকার অনেক ফুটবলার আজ ভালো ভালো জায়গায় খেলছে। মেয়েদের এবার ইচ্ছা তারা নিজেদের ক্লাবের হয়ে লিগ খেলবে। এতে তাদের প্রতিভার আরও বিকাশ ঘটবে। তাছাড়া নারী ফুটবল লিগ খেলার জন্য যেসব শর্তাবলি প্রয়োজন, তার সব শর্তই সদ্যপুষ্কুরিনী পূরণ করেছে। দেশে যে কয়টি দল আবেদন করেছে, এর মধ্যে একমাত্র সদ্যপুষ্কুরিনী যুব স্পোর্টিং ক্লাব মেয়েদের নিজস্ব ক্লাব। তাই আমরা আশা করছি, এখানকার মেয়েরা এবার নিজেদের ক্লাবের পরিচয়ে মাঠে নামতে পারবেন।
তবে আমরা এবার ফিটনেস নিয়ে কাজ করেছি। কিছু খেলোয়াড়কে নিয়ে বিশেষভাবে কাজ করা হয়েছে। যদি এবারের লিগে সদ্যপুষ্কুরিনী যুব স্পোর্টিং ক্লাবকে সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে মেয়েরা ভালো করবে। দেশের ফুটবল অঙ্গনের উন্নয়নে ক্লাবটি ভূমিকা রাখবে।
মিলন খান রাজ, প্রশিক্ষক, কিশোরী ফুটবল দল
কিশোরী ফুটবলারদের প্রশিক্ষক মিলন খান রাজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের ১২ থেকে ১৩ জন খেলোয়াড় বিভিন্ন বয়সভিত্তিক বাংলাদেশ দল ও জাতীয় পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব করে। নারী লিগে এফসি উত্তরবঙ্গের হয়ে পুরো লিগে খেলেছে আমাদের মেয়েরা। শুরুতেই ভালো খেললেও পরে ফিটনেসের কারণে ভালো খেলতে পারেনি।
তিনি আরও বলেন, সকালে ও বিকেলে মেয়েরা ওয়ার্মআপ অ্যাক্টিভেশন, পাসিং প্র্যাকটিস, পজিশন গেম, গেম ট্রেনিং, ট্রেনিং গেম ও কুল ডাউন অনুশীলন করছে। এ ছাড়া ফিটনেস ট্রেনিংও করানো হচ্ছে। লিগে ক্লাবের হয়ে খেলার সুযোগ হবে, এমন আশা থেকেই দেড় বছর ধরে নারী ক্যাম্পটি পরিচালনা করে আসছি। দেশে নারী ফুটবলের উন্নয়নে এটি প্রথম দীর্ঘ মেয়াদি ক্যাম্প। আমরা এখন সবদিক থেকে প্রস্তুত। শুধুমাত্র বাফুফের ইঙ্গিতের অপেক্ষায় রয়েছি আমরা।
আরএআর/এনএ