নিজের শাড়ি কেটে মেয়ের জামা বানিয়ে দিয়েছি
ব্যবসায়ী স্বামী রঞ্জিত বসাক হঠাৎ মারা যান। তখন তার ছেলে সঞ্জিতের বয়স ৬ বছর এবং মেয়ে শেফালীর মাত্র আড়াই বছর। চিরকুমার ভাসুরের রান্না করে দেওয়ার শর্তে দুবেলা কোনোরকমে খাবারের ব্যবস্থা হলেও মাথায় আসে ছেলে-মেয়েকে মানুষের মতো মানুষ করার চিন্তা।
শুরু করেন জীবনের নতুন অধ্যায়। স্বপ্না রানী বসাক (৬৭) বিয়ের ৮ বছরের মাথায় হারিয়েছেন স্বামীকে। তখন ৬ বছর বয়সী ছেলে আর আড়াই বছর বসয়ী শিশুকন্যা তার কোলে। স্বামী মারা যাওয়ার সময় ছিল না কোনো সম্পদ বা নগদ টাকা। অথই সাগরে পড়ে তিনি খুঁজতে থাকেন দিশা।
বিজ্ঞাপন
বাড়িতে এমব্রয়ডারি কাজ করার পাশাপাশি তখন কাজ করতেন একটি সমবায় সমিতিতেও। সন্তানদের কথা ভেবে করেননি দ্বিতীয় বিয়েও। লক্ষ্য একটাই, সন্তান দুজনকে মানুষের মতো মানুষ করবেন। আজ তার ছেলে-মেয়ে দুজনেই প্রতিষ্ঠিত। দুজনেই ব্যাংকার। জীবনসংগ্রামে সফল হয়ে স্বপ্নার চোখেমুখে ফুটেছে হাসির আনন্দ।
স্বপ্নার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্বপ্নার স্বামী রঞ্জিত বসাক মারা গেছেন ১৯৮৭ সালে। স্বপ্না এখন সিরাজগঞ্জ পৌর এলাকার ১০ নং ওয়ার্ডের ধানবান্ধি নবদ্বীপপুল মহল্লায় বসবাস করেন। তার ছেলে সঞ্জিত কুমার বসাক ২০১৬ সাল থেকে কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করছেন পদ্মা ব্যাংকের ময়মনসিংহ শাখায়। মেয়ে শেফালী রাণী বসাক ২০১৭ সাল হতে কর্মকর্তা (ক্যাশ) হিসেবে চাকরি করছেন ন্যাশনাল ব্যাংকের সিরাজগঞ্জ শাখায়।
কষ্টের দিনের স্মৃতিচারণা করে স্বপ্না বসাক ঢাকা পোস্টকে জানান, ১৯৮৭ সালে তার পান ব্যবসায়ী স্বামী রঞ্জিত বসাক হঠাৎ মারা যান। তখন তার ছেলে সঞ্জিতের বয়স ৬ বছর এবং মেয়ে শেফালীর মাত্র আড়াই বছর। চিরকুমার ভাসুরের রান্না করে দেওয়ার শর্তে দুবেলা কোনোরকমে খাবারের ব্যবস্থা হলেও মাথায় আসে ছেলে-মেয়েকে মানুষের মতো মানুষ করার চিন্তা। ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে শুরু করেন এমব্রয়ডারি কাজ। সারা মাস এমব্রয়ডারি কাজ করে আসত সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা, যা দিয়ে দুটি শিশু সন্তানকে নিয়ে চলা ও ছেলেমেয়েকে পড়াশোনা করানোর পাশাপাশি পোশাক-আশাক দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। তাই এমব্রয়ডারি কাজের পাশাপাশি শুরু করেন একটি সমবায় সমিতিতে পাট দিয়ে পণ্য বানানোর হাতের কাজ। যেখান থেকে মাস শেষে বেতন বাবদ মাত্র ২৫-৩০ কেজি গম। এই গম থেকেও আবার কিছুটা খাওয়ার পর বাকিটা বিক্রি করে সেই টাকা সমিতিতে সঞ্চয় করতেন ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যৎ ও পড়াশোনার খরচের জন্য।
বিজ্ঞাপন
ছেলে-মেয়ের সাফল্যে স্বপ্না বলেন, আজ আমার ছেলে পদ্মা ব্যাংকে কর্মরত এবং মেয়ে কর্মরত ন্যাশনাল ব্যাংকে। দুজনকে ব্যাংকার বানাতে গিয়ে কী পরিমাণ কষ্ট আমাকে সইতে হয়েছে, সেটা একমাত্র আমিই জানি। ছেলে শান্ত হলেও হলেও মেয়ের বায়না ছিল অনেক বেশি। একবার নতুন পোশাক দিতে পারিনি মেয়েকে। পরে নিজের শাড়ি কেটে মেয়েকে জামা বানিয়ে দিয়েছি। ছেলে-মেয়ে সেসব দিন পার করে আজ তারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, নিজের সংসার হয়েছে। তারা আমাকে অনেক ভালোবাসে।
তিনি জানান, অনেক কষ্ট করার পরে আজ সৃষ্টিকর্তা মুখ তুলে তাকিয়েছেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর বাচ্চাদের ভালো-মন্দ খাওয়াতে পারিনি। চাল-ডালের অভাব, ছিল না রান্নার খড়িও। মাত্র ৫০০ টাকা ও ১০ কেজি গমে চলতে হতো সারা মাস। এর মধ্যে থেকেই দিতে হতো ছেলে-মেয়েদের টিউশনের টাকা। পূরণ করতে পারিনি ছেলে-মেয়েদের বড় কোনো আবদার ও চাহিদা। তাদের আবদার চাহিদা মেটাতে না পেরে রাগে তাদেরই মারধর করেছি। মনে জেদ ছিল, যেকোনো কর্ম করে তাদের লেখাপড়া করাতে হবে। টাকা না থাকায় তাদের বিজ্ঞান বিভাগে পড়াতে পারিনি। চাইলেও তারা পরিপূর্ণ সুযোগ সুবিধা পায়নি, তবু নিজেদের ইচ্ছা ছিল জন্যই মানুষ হতে পেরেছে। এমনকি মেয়ে একটু বড় হলে সে আমাকে সেলাইয়ের কাজে সহযোগিতা করেছে।
আজ আমার স্বপ্ন সত্যি হয়েছে জানিয়ে স্বপ্না বসাক বলেন, দুজনকে মানুষ করতে পেরেছি, সুশিক্ষিত করতে পেরেছি, দুজনেই এখন নিজ কর্মস্থলে কাজ করে যাচ্ছে, নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। জীবন ও কষ্টের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাদের আজকে এখানে নিয়ে আসতে পেরেছি, এটাই যেন জীবনের বড় পাওয়া।
সব মিলিয়ে এখন কেমন আছেন, জানতে চাইলে স্বপ্ন বলেন, এখন ছেলে-মেয়ের সুখে সুখ খুঁজি। কিন্তু চিকিৎসাটা ঠিকমতো করতে পারি না। ভেবে খুব কষ্ট হয়, জীবনে এত কষ্ট করলাম, এখন বয়সের কারণে সেই কষ্টই করতে হচ্ছে।
স্বপ্না বসাকের মেয়ে শেফালী রানী বসাক ঢাকা পোস্টকে বলেন, যখন বাবা মারা যান, তখন আমরা খুবই ছোট। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই দেখেছি মায়ের জীবনসংগ্রাম। কতটা কষ্ট করে আমাদের বড় করেছেন, মানুষ করেছেন। এখন আমরা দুই ভাই-বোনই পড়াশোনা শেষ করে ব্যাংকে চাকরি করছি। সেদিন যদি মা এতটা পরিশ্রম না করতেন, আজ আমরা পড়াশোনাও করতে পারতাম না, প্রতিষ্ঠিতও হতে পারতাম না। মায়ের প্রতি আমরা চিরকৃতজ্ঞ।
স্বপ্না রানী বসাকের ছেলে সঞ্জিত কুমার বসাক বলেন, আমার মায়ের প্রতিদান দেওয়া সম্ভব নয়, এসব দেওয়া যায় না। প্রত্যেক মায়েরই উচিত ছেলে-মেয়েদের এভাবে মানুষ করা। আবার সন্তানের উচিত মাকে ভালো রাখা। আমার মা সমাজের আর দশটা মায়ের জন্য মডেল হতে পারেন। তাকে দেখে অনেকেই প্রেরণা পেতে পারেন কীভাবে এতটা কষ্ট করে অনেক প্রতিকূলতার মাঝেও শুধু সদিচ্ছা থাকলে ছেলে-মেয়েদের মানুষ করা যায়।
এনএ