বাংলাদেশের প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ঋতুর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। ৪০ দিনের কর্মসৃজন প্রকল্পে গ্রামের হতদরিদ্র লোকজনের কাজ করার কথা থাকলেও তা করানো হয়নি বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, অল্প কয়েক দিন কাজ করিয়ে সরকারের দেওয়া টাকা চেয়ারম্যান ও তার কাছের লোকজন আত্মসাৎ করেছে।

নজরুল ইসলাম ঋতু ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার ৬ নং ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের নবনির্বাচিত তৃতীয় লিঙ্গের চেয়ারম্যান। গত ৩ জানুয়ারি চেয়ারম্যান হিসেবে শপথ নেন তিনি। পরিষদের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই নিজের ইউনিয়নের বিভিন্ন উন্নয়নের বিষয় নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। 

এদিকে ১৫ জানুয়ারি অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির আওতায় তিনটি প্রকল্পের কাঁচা রাস্তার কাজ পান। ৫ মার্চ কাজটি সম্পন্ন করেন। উপকারভোগীরা ১৩ মার্চ প্রথম কিস্তির টাকা পান নগদ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে। ওই ইউনিয়নে মোট উপকারভোগীর সংখ্যা ৯৩ জন। সেখানে প্রথম কিস্তির টাকা পেয়েছেন ৫৭ জন, এখনো ৩৬ জন উপকারভোগী টাকা পাননি। এ কারণে প্রকল্পের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে।

কালীগঞ্জ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য মতে, কালীগঞ্জ উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে মোট ৩২টি প্রকল্পের কাজ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬ নং ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নে ৩টি প্রকল্পে ১ লাখ ১১ হাজার ৬০০ ঘনফুটের কাজে বরাদ্দ আসে ১৪ লাখ ৮৮ হাজার টাকা এবং উপকারভোগী হলেন ৯৩ জন।

প্রকল্প তিনটি হলো-গোপীনাথপুরের পাকা রাস্তা হতে ফজলু বিশ্বাসের বাড়ির পাশের রাস্তা হয়ে আতিয়ারের বাড়ির সামনে পর্যন্ত মাটির কাঁচা রাস্তা সংস্কার। এখানে কাজ করার কথা ছিল ৩০ জন উপকারভোগী, ৩৬ হাজার ঘনফুট মাটি দ্বারা রাস্তাটি সংস্কার করা হবে। আর এর জন্য বরাদ্দ ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা।

ত্রিলোচনপুর পাকা রাস্তা সংলগ্ন ফজলু বিশ্বাসের পাশের রাস্তা হতে নুরো মিয়ার বাড়ির সামনে মাটির কাচা রাস্তা সংস্কার। এখানে কাজ করবেন ৩০ জন উপকারভোগী, মাটির ঘনফুট হবে ৩৬ হাজার এবং বরাদ্দকৃত টাকা হলো ৪ লাখ ৮৮ হাজার। 

দাঁতপুর হাফিজুর মন্ডলের বাড়ির সলিং রাস্তার মাথা হতে মুন্তা মন্ডলের বাড়ির সামনে পর্যন্ত মাটির কাঁচা রাস্তা সংস্কার। এখানে কাজ করবেন ৩৩ জন উপকারভোগী, মাটির ঘনফুট হবে ৩৯ হাজার ৬০০। এই রাস্তার জন্য বরাদ্দকৃত টাকা ছিল ৫ লাখ ২৮ হাজার। এর মধ্যে ১৩ মার্চ ৫৭ জন উপকারভোগীর নগদ অ্যাকাউন্টটের মাধ্যমে প্রথম কিস্তির টাকা দেওয়া হয়েছে। 

গোপিনাথপুর গ্রামের কৃষক সঞ্জয় জানান, ১৫-১৬ দিন আগে কাঁচা রাস্তাগুলোর কাজ শেষ হয়েছে। কোথাও ১৬ জন কোথাও ১৫ জন করে দল বেঁধে কাজ করেছে। মূলত বিভিন্ন খেত-খামারে কাজ করে এমন শ্রমিকরা এই কাজ করেছে।

প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা ৮ নং ইউপি সদস্য উসমান জানান, রাস্তা সংস্কারের কাজ ঠিকভাবেই উপকারভোগী দিয়ে করানো হয়েছে। প্রকল্পে কাজ করেনি, এমন কারো নামে টাকা পাওয়ার কোনো সুযোগ নাই। তার স্বজনরা দুই-তিন জন খুবই গরিব। তাদের দিয়ে কাজ করানো হয়েছে। কাজ চলাকালীন প্রকল্প কর্মকর্তা সরেজমিনে দেখে ছাড়পত্র দেওয়ার পরই শ্রমিকরা টাকা পেয়েছে।

৬ নং ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ঋতু বলেন, আমি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান হিসেবে নতুন। কোনো প্রকল্প সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা নেই। এবারই প্রথম অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির প্রকল্পের কাজ এসেছে। প্রকল্প আসার পর পুরোনো মেম্বারদের ডেকে মিটিং করে পরামর্শ নেওয়া হয়েছে। পরে তিনজন মেম্বারকে কাজ বুঝিয়ে দিয়েছি।

ইতোমধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। তিনটি রাস্তায় শ্রমিক দিয়ে কাজ করানো হয়েছে।তাদের ফোনেই সরকার টাকা দিচ্ছে। টাকাগুলো তো সরকার আমার হাতে দিচ্ছে না, তাহলে কীভাবে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করা হলো। এছাড়া আমার এখানে প্রথম কিস্তির টাকা দেওয়া শেষ হয়নি। সঠিক নিয়মে কাজ হচ্ছে। এখানে আমাদের কোনো দুর্নীতি করার সুযোগ নেই।

তিনি আরও বলেন, আমার ইউনিয়নে দুর্নীতি করার কোনো সুযোগ নেই। আমি নতুন হিসেবে মেম্বারদের দিয়ে কাজ করাতে গিয়ে কোনো ত্রুটি হয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখা হবে। সেক্ষেত্রে কোনো প্রকল্পের কাজ যদি ভালোমতো না হয় সেগুলো ঠিক করা হবে। পরবর্তীতে আমি নিজ হাতে জনগণকে নিয়ে উন্নয়নের কাজ করব। কেউ যদি কোনো সুযোগ নিতে চাই, তাহলে কাউকেই কোনো সুযোগ দেওয়া হবে না। নিজ হাতে দুর্নীতি প্রতিরোধ করব। আর আমাকে নিয়ে যে নিউজ করা হয়েছে সেই সাংবাদিক সরেজমিনে এসে দেখে যাক রাস্তার কাজ হয়েছে কি না। 

কালীগঞ্জ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ্-হেল আল মাসুম ঢাকা পোস্টকে বলেন, কালীগঞ্জ উপজেলার ১১ ইউনিয়নে ২০২১-২২ অর্থবছরে অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির আওতায় ৩২টি প্রকল্পের কাজ প্রথম পর্যায়ে শেষ হয়েছে। কাজটি শুরু হয় ১৫ জানুয়ারি। এবার জেটিপি পদ্ধতিতে শ্রমিকদের টাকা পরিশোধ করা হচ্ছে। মূলত মোবাইল ব্যাংকিং সিস্টেমের মাধ্যমে শ্রমিকদের মোবাইলে টাকাগুলো অধিদপ্তর থেকে দেওয়া হয়েছে। ফলে টাকা লেনদেনের বিষয়ে চেয়ারম্যান কিংবা আমাদের হাত নেই।

তিনি আরও বলেন, উপজেলাতে প্রকল্পের কাজ হয়নি এমন কোনো ইউনিয়ন নেই। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শ্রমিক নির্বাচন করে করে ট্যাগ অফিসারের উপস্থিতিতে তালিকা তৈরি করা হয়। কাজ চলাকালীন আমরা সব ইউনিয়নে গিয়েছি, সেখানে শ্রমিক সংকটের কোনো বিষয় চোখে পড়েনি। আমাদের ডিজাইন অনুযায়ী কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নসহ সব ইউনিয়নে কাজের মান সন্তোষজনক। এখানে ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের চেয়াম্যানের দুর্নীতি করার কোনো সুযোগ নাই। তৃতীয় লিঙ্গের এই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে যা প্রচার করা হচ্ছে, তথ্যগুলো সঠিক নয়। 

এসপি