মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার ভাড়ারিয়া ইউনিয়নের বরুনা এলাকায় গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কারের (কাবিটা) আওতায় রাস্তা পুনর্নির্মাণ কাজে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. মোক্তার আলীর বিরুদ্ধে। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশ করে স্থানীয় ইউপি সদস্য রাস্তা নির্মাণ কাজে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।

প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি নিজেই এই রাস্তা পুনর্নির্মাণের কাজ করেছেন। যে কারণে রাস্তার কাজে অনিয়মে এলাকাবাসী মৌখিকভাবে বাধা দিলেও তা কর্ণপাত করেননি ইউপি সদস্য মোক্তার আলী। ব্যক্তি মালিকানাধীন জমির ওপর দিয়ে রাস্তা এবং একপাশের ফসলি জমির মাটি কেটে রাস্তা করায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন জমির মালিকরা। জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেননি প্রকল্পের সভাপতি।

জানা গেছে, মানিকগঞ্জ-২ আসনের নির্বাচনী এলাকা সদর উপজেলার ভাড়ারিয়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বরুনা গ্রামে রাস্তা পুনর্নির্মাণের জন্য গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কারের (কাবিটা-খাদ্যশস্য/নগদ অর্থ) আওতায় ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ১ম পর্যায়ে এমপি কোটায় বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রকল্পে ‘বরুনা দুঃখী রামের বাড়ির মোড় হতে ভাষাণ মোল্লার বাড়ি পর্যন্ত’ ২১০০ মিটার রাস্তা পুনর্নির্মানের জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হয় ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আর প্রকল্পে কাজ চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে শেষ হয় চলতি মাসের ১৫ তারিখে। প্রকল্পের সভাপতি নিজেই কাজটি করতে পারেন কিনা তার কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখা দিতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

সরেজমিনে দেখা যায়, রাস্তাটির এক পাশে ফসলি জমি আর অন্যপাশে বসতবাড়ি। রাস্তার একপাশের ফসলি জমির মাটি কেটে রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। লেবারের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে ভেকু মেশিন। জমির কিছু অংশ গভীর করে কাটায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন জমির মালিকরা। এছাড়া প্রকল্পের কাজের কোনো নামফলক দেখা যায়নি সেখানে। তবে রাস্তার কাজের তথ্য সংগ্রহ করার সময় সাংবাদিকদের দেখে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ও স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. মোক্তার আলী একটি ব্যানার নিয়ে আসেন এবং রাস্তাটির একপাশে তা লাগিয়ে দেন। কাজ শুরুর সময় স্থানীয় কয়েকজন বাধা দিলে তাদের ম্যানেজ করা হয়। এরপর রাস্তা থেকে তাদের বাড়িতে প্রবেশ করার সংযোগ সড়কে ইউপি সদস্য মাটি ফেলে দিয়েছেন বলে জানায় এলাকাবাসী।

স্থানীয় বাসিন্দা সামেনা বেগম বলেন, ‘আমার এই ক্ষেত কাটপার দিমু না, বাধা দিছিলাম তা হুনে নাই। কয় দিতে বাধ্য, এহনে না দিলে পরেও জমির মাটি দিতে হবে। দুই দিন কাজ বন্ধ ছিল। আমি কইছি খাস জমি থেকে মাটি নেও, তা না নিয়া কয় কিছু মাটি নিমু। এই কইয়া ভেকু দিয়ে মেলা মাটি নিছে। বেশি গভীর করে মাটি নেয় দেইখা ভেকুর চালককে ঝাঁটা দিয়ে বাড়ি দিতে গেছিলাম। এতো গর্ত কইরা মাটি নিতাছ ছোট পোলাপান গর্ত পইরা মরবো না।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বরুনা এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত এক জমির মালিক বলেন, ‘জমি থেকে যেমনে মাটি কাটছে তাতে কইরা কপি বুনুম কেমনে, কোনো শস্যই তো বুনতে পারুম না। জোড় কইরাই আমার জমির মাটি নিয়া গেছে। এই খেতে আর কোনো ফসল তো হইবো না। মোক্তার (ইউপি সদস্য) তো ক্ষতিপূরণ দিল না। খাস জমি থেকে মাটি কাটলে তাগো (ইউপি সদস্য) পোষায়বো না। আমাগো জমির মাটি নিয়া রাস্তা করছে, এতে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা খরচ হইছে। বাকি টাকা কই গেল। মেম্বার আমাগো ক্ষতিপূরণ দিল না, রাস্তার কাজও ভালো মতো করে নাই।

জমির মালিক রাকিব বলেন, ‘সরকারিভাবে রাস্তা করার জন্য কাজ আসছে। তারা (প্রকল্প সভাপতি) খাস জমি দিয়ে রাস্তা না করে আমাদের জমির ওপর দিয়ে রাস্তা করছে। আমরা না করছি, কিন্তু আমাগো কথা শুনে নাই। আর ক্ষতিপূরণও দেয় নাই।’

বরুনা গ্রামের কৃষক আওলাদ হোসেন বলেন, ‘এখানে আমার খেত আছে, ক্ষতিও হইছে। প্রথমে আমিসহ এলাকায় অনেকেই বাধা দেই। আমাগো জমির ওপর দিয়ে রাস্তা তো দিয়াই ফেলাইছে। এজন্য আমরা জমির মালিকরা মোক্তারকে (ইউপি সদস্য) বলছি, এই কাজ জন্য সরকার টাকা ঠিকই দিছে, জমিও নেবেন, আবার জমি থেকে মাটি কেটে নিয়ে রাস্তা করবেন। তাহলে আমাদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে রাস্তার কাজ করেন। এই কথা বলার পরে মেম্বার এলাকার এবং বাহিরে থেইকা কয়েকজন লোক নিয়া আসে এবং আমাগো বলে, এই কাজ আমারা করবোই, মাটি কাটা বন্ধ হবে না, এটা এমপি কোটার কাজ। আমরা গরিব কৃষক মানুষ, আমাদের সমস্যার কথা কে শুনবো কন।’ 

এ বিষয়ে প্রকল্পের সভাপতি ও অভিযুক্ত ইউপি সদস্য মোক্তার আলী বলেন, এই প্রকল্পের সভাপতি ও ঠিকাদার আমি নিজেই। বিষয়টি সদর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা জানেন। 

বিষয়টি স্থানীয় চেয়ারম্যান জানেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তার তো জানার কথা না। কারণ কাজটা আমাকে দিয়েছেন এমপি মমতাজ। আর এ কারণেই তাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করি নাই।

মুঠোফোনে যোগযোগ করা হলে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মোহাম্মদ একরামুল হক বলেন, জেলা প্রশাসক বা ইউএনও স্যারের অনুমতি নিয়ে আসেন, তারপর আমি এ বিষয়ে কথা বলব। এই বলে তিনি ফোন রেখে দেন।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আব্দুল লতিফ বলেন, বিষয়টি আপনাদের (গণমাধ্যমকর্মী) মাধ্যমেই জানতে পেরেছি। এর আগে এ বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। খোঁজখবর নিয়ে ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

সোহেল হোসেন/আরএআর