ছয় শিক্ষার্থীর করুণ সমাপ্তি, স্বপ্নগুলো এখন স্মৃতি
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় স্বজনহারাদের আহাজারি
ছাত্রজীবনের শেষ ধাপের পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। স্বপ্ন ছিল নিজের, মা-বাবার, আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর। হয়তো পরিবার, প্রতিবেশীর এবং দেশের মুখ উজ্জ্বল করতেন। কিন্তু না। তা আর করা হয়নি। সবার স্বপ্ন অপূর্ণ রেখে সড়কের বুকে রক্তের স্রোত বইয়ে একসঙ্গে পরপারে পাড়ি জমালেন তারা ছয়জন। স্বপ্ন পূরণের বদলে মায়ের কোলে ফিরল ছয়জনের লাশ।
বলছি যশোর সরকারি এম এম কলেজের মাস্টার্সের ছয় শিক্ষার্থীর কথা; যারা পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার বারোবাজার এলাকায় বাস-ট্রাকের সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন। তাদের অকালে চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছেন না কেউ। শোকের ঢেউ আছড়ে পড়ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এরই মধ্যে দুদিনের শোক পালন শুরু করেছে এম এম কলেজ কর্তৃপক্ষ।
বিজ্ঞাপন
বারোবাজারে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তাদের ছয়জনের সঙ্গে নিহত হয়েছেন আরও পাঁচজন; আহত হয়েছেন ৩০ জন। আহতদের কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও যশোর সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, যশোর সরকারি এম এম কলেজের মাস্টার্সের ছয় শিক্ষার্থীর বাড়ি ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন এলাকায়। পরীক্ষা শেষে বাড়ি ফেরার জন্য বাসে উঠেছিলেন তারা। এই পরীক্ষাই ছিল তাদের জীবনের শেষ পরীক্ষা।
বিজ্ঞাপন
তারা হলেন ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের সুন্দরপুর গ্রামের ইসহাক আলীর ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান কল্লোল (২৫), কালীগঞ্জ উপজেলার ভাটপাড়া গ্রামের রনজিত দাশের ছেলে সনাতন দাশ (২৫), ঝিনাইদহ সদরের নাথকুন্ডু গ্রামের আব্দুল ওয়াহেদের ছেলে ইউনুস আলী (২৪), কোটচাঁদপুর উপজেলার হরিনদিয়া গ্রামের মোহাম্মদ আলীর ছেলে হারুনুর রশিদ সোহাগ (২৪), চুয়াডাঙ্গা সদরের ডিঙ্গেদহ গ্রামের আব্দুর রশিদের মেয়ে রেশমা (২৬) এবং একই এলাকার আব্দুল আজিজ (২৫)।
এদের মধ্যে ইউনুস আলী, হারুনুর রশিদ ও সনাতন দাশ এম এম কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী; মোস্তাফিজুর রহমান, রেশমা ও আব্দুল আজিজ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের।
মৃত্যুর অমোঘ নিয়মে জীবনের সমাপ্তি হলেও এম এম কলেজের নিহত ছয় শিক্ষার্থী আছেন কলেজের বন্ধু-অনুজদের হৃদয়ে। কারও ফেসবুকের কাভারফটো, আবার কারও ফেসবুকে আড্ডা, কর্মচঞ্চল ও উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়া ছয় শিক্ষার্থীর ছবি দুর্ঘটনার পর থেকেই ঘুরছে নিউজ ফিডে। সবার শেষ চাওয়া ওপারে ভালো থাকুক তারা ছয়জন।
এম এম কলেজের যে ছয় শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন তাদের সহপাঠী খালিদ হুসাইন। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘পরীক্ষা শেষে বাড়ি ফিরছিল তারা। স্বপ্ন ছিল একদিন বড় অফিসার হয়ে পরিবার ও এলাকার সুনাম বাড়াবে। তাদের সঙ্গে যারা শেষবারের মতো পরীক্ষা দিয়েছে তারাও হয়তো ভাবেনি, এটাই শেষ দেখা। এদের পরীক্ষার ফলাফল আসবে ঠিকই। কিন্তু ভোগ করা হলো না।’
রাষ্ট্রবিজ্ঞান তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী এসএম রাশেদ আনোয়ার সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত তার বিভাগের বড় ভাই আব্দুল আজিজের একটি ছবি পোস্ট করে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘ছেলেটার নাম আব্দুল আজিজ, পরীক্ষা শেষে বাসযোগে বাড়ি ফিরছিল। যশোর-কালীগঞ্জের মাঝামাঝিতে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে যশোর সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়। অবস্থা খারাপ বুঝতে পেরে তাকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়। আমি যখন হাসপাতালে গেলাম তখন স্বাভাবিক দেখেছিলাম, কিছুক্ষণ পর তার মা-বাবা এবং বোন হাসপাতালে পৌঁছায়, মায়ের কোলে মাথা রাখা এবং বাবার হাতে হাত রাখার কিছুক্ষণ পরই ছটফট শুরু করে। তার জন্য রক্তের ব্যবস্থা করি। এরই মধ্যে মায়ের কোলে মাথা রেখে আব্দুল আজিজের আজীবনের জন্য ঘুমিয়ে পড়াটা কিছুতেই মানতে পারছি না। আব্দুল আজিজের মাকে কোনোভাবেই সান্ত্বনা দিতে পারছিলাম না।’
রাশেদ আনোয়ার আরও লিখেছেন, ‘আজিজের বৃদ্ধা মা শুধু চিৎকার দিয়ে কেঁদে কেঁদে বলছেন, আমার ছেলেটা সকালে খেয়ে আসেনি, আমাকে বলেছে আমি দোকান থেকে ডাল-পরোটা খেয়ে নেব, আমার ছেলে দোকানে কাজ করে, আবার পড়াশোনাও করে। আমার সোনার মানিক এমন করে শুয়ে আছে কেন? আমি বুঝেছিলাম মায়ের মনে তো আর বোঝে না, ছেলের অকাল মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না। তার বাবাও বরফের মতো জমাট হয়ে গেছেন। মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। বৃদ্ধ মা-বাবার হাজারো স্বপ্ন তাদের ছেলেকে নিয়ে। মাস্টার্স পাস করে ভালো চাকরি করবে, তাদের সংসারের হাল ধরবে। শেষ বয়সে নাতি-নাতনি নিয়ে আনন্দে কাটবে জীবন। কিন্তু সব স্বপ্ন অপূর্ণ রেখে তাদের ছেলে না ফেরার দেশে পাড়ি জমাবে; এটা তারা মানতে পারছেন না। মা-বাবার কাছে সন্তানের লাশ কত বড় বোঝা তা আমি বুঝব না। কিন্তু যে মা-বাবার বুক খালি হয়েছে তারা ঠিক বুঝতে পারছেন। আল্লাহ তুমি, আব্দুল আজিজকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন।’
যশোর সরকারি এম এম কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল মজিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, একসঙ্গে আমাদের কলেজের ছয় শিক্ষার্থী নিহত হওয়ায় আমরা গভীরভাবে শোকাহত। আমাদের আরও ১০ শিক্ষার্থী আহত হয়েছে। দুর্ঘটনার পরপরই হতাহতদের খোঁজখবর নিয়েছি। কলেজের তহবিল থেকে আহতদের চিকিৎসার ব্যয় বহনের দায়িত্ব নেওয়া হয়েছে। এছাড়া দুই দিনের শোক পালন করছি আমরা। নিহতদের আত্মার শান্তি ও আহতদের সুস্থতা কামনায় কামনায় ১৩ ফেব্রুয়ারি কলেজে দোয়া ও স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হবে।
বুধবার (১০ ফেব্রুয়ারি) বিকেল ৩টার দিকে যাত্রী নিয়ে যশোর থেকে কুষ্টিয়ায় যাচ্ছিল জে কে পরিবহনের বাস। কালীগঞ্জের বারোবাজার এলাকায় পৌঁছালে বাসটিকে ওভারটেক করে একটি ট্রাক। এ সময় বাসচালক নিয়ন্ত্রণ হারালে মহাসড়কের ওপর বাসটি উল্টে যায়। ঠিক তখন বিপরীত দিক থেকে আসা আরেকটি ট্রাক বাসকে ধাক্কা দিলে ঘটনাস্থলেই বাসের নয়জন নিহত হন। পাশাপাশি আরও ২২ জন আহত হন। আহতদের কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও যশোর সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে আরও দুজনের মৃত্যু হয়।
জাহিদ হাসান/এএম