আইলা থেকে আম্ফানে ভেসেছে সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চল। সবশেষ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইয়াসও ভাসিয়েছে সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগরকে। বসতভিটা, কবরস্থান, মসজিদ, জমি হারিয়েছেন মানুষ। জনবসতির স্থান পরিণত হয়েছে নদীর সংযোগ খালে। ভিটেমাটি হারিয়ে কেউ পাড়ি জমিয়েছেন অন্যত্র কেউবা আশ্রয় নিয়েছেন বাঁধের ওপর। ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ২৫০টি পরিবার আটকা পড়েছে পানিতে।

বেসরকারি সংগঠন ডু সামথিং ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আটকা পড়া মানুষদের চলাচলের জন্য দুই লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে ভাসমান ব্রিজ। ব্রিজ হওয়ায় কমে গেছে তাদের দুর্ভোগ। অথচ নৌকায় পারাপার হতে জনপ্রতি তাদের ১০ টাকা করে ব্যয় করতে হতো।

ভাসমান ব্রিজ নির্মাণ কাজের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা প্রতাপনগর গ্রামের বাসিন্দা সাইদুর রহমান জানান, ৩ মার্চ থেকে ভাসমান ব্রিজটির নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। চারজন শ্রমিকের সঙ্গে আমিও কাজ করেছি। মঙ্গলবার (২৯ মার্চ) দুপুরে নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। তবে এক দিন আগেই ব্রিজটি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। 

তিনি বলেন, ৩৫০ ফুট দৈর্ঘ্যের ব্রিজটি নির্মাণ করতে ৫৬টি দুই লিটারের ড্রাম, ৫০ সেফটি মেহগনি কাঠ, ৫০ সেফটি চম্বল কাঠ, ২৫০ সেফটি সৃষ্টিফুল কাঠ এবং ৬০ কেজি পেরেক ব্যবহার করা হয়েছে। ব্রিজটির কাজ শেষ করতে ব্যয় হয়েছে প্রায় দুই লাখ টাকা। ব্রিজটি নির্মাণে অর্থায়ন করেছে ডু সামথিং ফাউন্ডেশন।

২০২০ সালের ২০ মে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ও ২০২১ সালের ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে ভেঙে যায় খোলপেটুয়া নদীর উপকূল রক্ষা বেঁড়িবাঁধ। বাঁধ ভেঙে তীব্রগতিতে পানি লোকালয়ে প্রবেশ শুরু করে। আশাশুনির প্রতানগর গ্রামের মধ্যদিয়ে শুরু হয় নদীর জোয়ার-ভাটা। এতে বিস্তীর্ণ এলাকা পরিণত হয়েছে নদীর সংযোগ খালে।

প্রতাপনগর গ্রামের সাইদুর রহমান বলেন, আম্ফান ও ইয়াসে খোলপেটুয়া নদীর হরিশখালি ও বন্যতলা এলাকার বেঁড়িবাঁধ ভেঙে বিস্তৃর্ণ এলাকা খাল হয়ে গেছে। আম্ফানে হরিশখালি এলাকার একটি, বন্যতলার একটি ও কুড়িকাওনিয়া এলাকার দুটি স্থানে বাঁধ ভেঙে যায়। ইয়াসে ভেঙেছিল হরিশখলির একটি ও বন্যতলার একটি পয়েন্ট। এসব বাঁধ ভেঙে লোকালয়ের প্রতাপনগর হওলাদার বাড়ি, সরদার বাড়ি, কাজি বাড়ি, কল্যাণপুর, সনাতনকাটি, নাকনার কিছু অংশ খাল হয়ে গেছে। 

তিনি বলেন, প্রতাপনগর গ্রামের হাওলাদার বাড়ি এলাকায় পানির মধ্যে আটকা পড়েছে ২৫০-৩০০ পরিবার। এদের চারপাশে পানি। বের হতে গেলে নৌকায় পারাপার হতে হয়। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ যেকোনো প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হলেই নৌকা একমাত্র বাহন। এতে জনপ্রতি খরচ হতো ১০ টাকা। জরুরি চিকিৎসাসেবার প্রয়োজনেও দ্রুত মানুষ চলাচল করতে পারছিল না। অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যে পড়েছিল প্রায় এক হাজার মানুষ। 

অবশেষে ডু সামথিং ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে পানিতে আটকা পড়া মানুষদের জন্য ভাসমান ব্রিজ করে দিয়েছে। যেখানে ব্রিজটি করা হয়েছে সেখানে পানির গভীরতা ১৮ হাত। বেঁড়িবাঁধ সংস্কার করা হলেও জোয়ার-ভাটা চলার সময়ের সৃষ্টি হওয়া গভীরতার মধ্যে পানি এখনো রয়ে গেছে।

স্থানীয় বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল ঢালী জানান, প্রতিদিন ৪০০-৫০০ জন মানুষ নৌকায় চলাচল করছিল। এই ভাসমান ব্রিজটি হওয়ায় দুর্ভোগে থাকা মানুষদের অনেক উপকার হয়েছে। তবে সরকারের কাছে এই জনপদটিকে রক্ষার দাবি জানাচ্ছি। আগের মতো রাস্তাঘাট নির্মাণসহ, জনবসতি গড়ে তোলার পরিবেশ সৃষ্টি করা হোক। 

প্রতাপনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু দাউদ বলেন, বন্যতলা এলাকার বাঁধ ভেঙে লোকালয়ের মধ্যে খাল হয়ে গেছে। বেঁড়িবাঁধটি পানি উন্নয়ন বোর্ড সংস্কার করে দিলেও লোকালয় থেকে ৫০০-৭০০ মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তারা নৌকা ছাড়া বের হতে পারছিল না। ভাসমান ব্রিজটি হওয়ায় তারা এখন যাতায়াত করতে পারবে।

ডু সামথিং ফাউন্ডেশনের সভাপতি ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্ফান এবং ইয়াসের কারণে প্রতাপনগরে বিশাল খাল তৈরি হয়েছে। সে কারণে দুই বছর ধরে প্রায় এক হাজার মানুষ মূল ভূখণ্ড থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এতে দৈনন্দিন স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছিল। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের যাতায়াতে কষ্ট হচ্ছিল, গুনতে হতো বাড়তি নৌকা ভাড়া। ভাসমান সেতু নির্মাণের ফলে উপকূলীয় বাসিন্দাদের আর কষ্ট থাকবে না। 

আকরামুল ইসলাম/এসপি