সুড়কি ওঠা সড়ক। নেই সড়কবাতি। সন্ধ্যা নামলেই ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসে পুরো গ্রামে। বছরখানেক আগে বিদ্যুৎ-সংযোগ পেলেও চারদিকে ঝোপ-জঙ্গলে চোর-ডাকাতের উৎপাত সারা বছর। ৫২টি ঘরের মানুষ ভোগেন নিরাপত্তাহীনতায়। মাঠে, খালে, পুকুরে পানি থাকলেও নেই সুপেয় পানির ব্যবস্থা। নেই স্যানিটেশনের নিশ্চয়তা। গাছে গাছে ঝুলছে বিদ্যুতের তার।

এদিকে শিশুদের জন্য একটি মাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়। তা নিয়েও নানা অভিযোগ স্থানীয়দের। সবচেয়ে দুর্ভোগের ব্যাপার হলো যাতায়াত। পরপর দুটি নদী পার হয়ে নয়তো আরেক জেলা ঘুরে ঢুকতে হয় এই গ্রামে। বরিশাল সিটি করপোরেশনের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের আওতায় চর জাগুয়ার চিত্র এমন। 

নাগরিক সুযোগ-সুবিধাবিবর্জিত গ্রামটি মূল শহর থেকে সড়কপথে যেতে সময় লাগে এক ঘণ্টারও বেশি। আর নদী পথে দুই সময়ে যাওয়া-আসা যায়। আগে স্থানীয়রা নিজের পকেটের টাকায় পারাপার হলেও বর্তমানে সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ একটি ট্রলার দিয়েছেন সকাল-বিকেল দুবার করে বাসিন্দাদের মূল শহরে নিয়ে আসার জন্য।

ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলা পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ―এই তিন দিক থেকে ঘিরে রেখেছে চরটি। এখানে সিটি করপোরেশনের কমপক্ষে ৫০০ বাসিন্দা বসবাস করেন। ভোট এলে কালেভদ্রে প্রার্থীরা আসেন। শুনিয়ে যান উন্নয়নের আশ্বাস। নলছিটির গর্ভে থাকা চর জাগুয়ার উত্তরের একটি বড় নদী ও একটি শাখা নদী পার হয়ে যাওয়া যায় বরিশাল সিটি করপোরেশনের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের কালীজিরা বাজার এলাকায়

ভালোর মধ্যে এই একটি কাজই হয়েছে বিগত এক দশকে, এমনটা বলেন প্রবীণ বাসিন্দা মতিউর রহমান। তিনি এই চর জাগুয়ার সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ। মতিউর বলেন, আগে নলছিটি উপজেলার জাগুয়া ইউনিয়নের মধ্যে ছিলাম। ১০ বছর আগে আমাগো করপোরেশন নিয়া গ্যাল। চাষাবাদ কইরা যা একটু খাইতাম, তহন খাজনা দিতাম কাঠায় ৮ টাকা। এখন করপোরেশনে গিয়া খাজনা দিই কাঠায় ৫০ টাকা। তয়, আগে শহরে যাইতে নৌকা পাইতাম না। সাদিক মেয়া একটা নৌকা দিয়া অনেক উপকার করছে। 

সরেজমিনে দেখা গেছে, ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলা পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ―এই তিন দিক থেকে ঘিরে রেখেছে চরটি। এখানে সিটি করপোরেশনের কমপক্ষে ৫০০ বাসিন্দা বসবাস করেন। ভোট এলে কালেভদ্রে প্রার্থীরা আসেন। শুনিয়ে যান উন্নয়নের আশ্বাস। নলছিটির গর্ভে থাকা চর জাগুয়ার উত্তরের একটি বড় নদী ও একটি শাখা নদী পার হয়ে যাওয়া যায় বরিশাল সিটি করপোরেশনের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের কালীজিরা বাজার এলাকায়।

ওয়ার্ড কাউন্সিলর হুমায়ন কবির বলেছেন, আপনারা জানেন বরিশাল সিটি করপোরেশনে দীর্ঘদিন ধরে বরাদ্দ বন্ধ রয়েছে। বরাদ্দ পেলেই চর জাগুয়া উন্নয়নকাজে হাত দিতে পারব। তিনি বলেন, ওখানে উন্নয়নের বেশি কিছু বাকি নেই। একটি সেতু, একটি রাস্তা সংস্কার করতে হবে। টেন্ডারের কাজ শেষ। এখন বরাদ্দ পেলেই উন্নয়ন করা সম্ভব।
 
স্থানীয়রা কাউন্সিলরের এমন আশ্বাস অনেকবার শুনেছেন, কিন্তু ভাগ্যোন্নয়ন হয়নি জানিয়ে বাসিন্দা শিউলী বেগম বলেন, সিটি করপোরেশন এলাকার বাসিন্দা আমরা। কিন্তু সিটির কোনো সুযোগ পাই না। আমরা অনেক কষ্টে আছি। কোনো সাহায্য কেউ দেয় না। সবাই বলে শুধু সিটির বাসিন্দা। কিন্তু উপকার নেই তাতে। কাউন্সিলর, মহিলা কাউন্সিলর কেউ আমাদের খোঁজ নেন না। 

আরেক বাসিন্দা সরোয়ার হোসেন ফারুক বলেন, এখানের বাসিন্দারা সবকিছুতেই সমস্যায় আছেন। পানি পাই না, রাস্তা নাই। সন্ধ্যা হয়ে গেলে যাতায়াতের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে জীবন শেষ হয়ে যায়। এই বাসিন্দা বলেন, হয় আমাদের নলছিটি পৌরসভায় দিয়ে দেওয়া হোক, নাহলে নাগরিক সুযোগ বৃদ্ধি করা হোক।

সরাকারকে ঠিক সময়ে ট্যাক্স দিচ্ছি। সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত ট্যাক্স দিচ্ছি। কিন্তু একজন নাগরিকের যে সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্য, তা পাচ্ছি না। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাতে এখান থেকে কষ্ট করে অনেক দূরে যেতে হয়

দেলোয়ার হোসেন, চরের বাসিন্দা

আরেক বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন বলেন, সরাকারকে ঠিক সময়ে ট্যাক্স দিচ্ছি। সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত ট্যাক্স দিচ্ছি। কিন্তু একজন নাগরিকের যে সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্য, তা পাচ্ছি না। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাতে এখান থেকে কষ্ট করে অনেক দূরে যেতে হয়।

মিলন নামের এক বাসিন্দা বলেন, অনেক বছর আগে একটি সেতু ছিল। তাতে সহজেই আমরা যাতায়াত করতে পারতাম। কিন্তু বালুর জাহাজ কয়েকবার ধাক্কা দিয়ে সেতুটি ভেঙে দিয়ে গেছে। এখন অনেক বেকায়দায় আছি। সেতুটি নির্মাণ হলে আমাদের দুঃখ অনেক লাঘব হতো।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এই গ্রামের একটি মাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ১২৩ নম্বর চর জাগুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি বর্তমানে বন্ধ। কিন্তু করোনাভাইরাস আসার আগে শিক্ষকরা ঠিকমতো আসতেন না। ছেলেমেয়েদের বাসায় লেখাপড়া করতে বলতেন। এমনকি বিদ্যালয়ের শিশুদের জন্য সরকারি টিউবওয়েলটিও চুরি হয়ে গেছে। টিউবওয়েলটি খুলে ফেলে মোটর বসিয়ে পানি উত্তোলন করে ব্যবহার করছেন স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মোনাব্বর খানের আত্মীয়।

এ বিষয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোসাম্মৎ মরিয়ম বেগম বলেন, টিউবওয়েল তুলে ফেলে অন্যকে পাইপ দিয়ে মোটর বসাতে দেওয়া আইন পরিপন্থি। তবে নতুন ভবনের কাজ শুরু হবে বিধায় মোটর চুরি যেন না হয়, সে কারণে আরেকজনের ঘরে মোটরটি বসিয়ে রাখা হয়েছে। 

সভাপতি মোনাব্বর খান বলেন, টিউবওয়েল সরিয়ে ফেললেও স্কুলের বাচ্চারা ঠিকমতোই পানি পাচ্ছে। যাদের ঘরে টিউবওয়েল থেকে পাইপ নেওয়া হয়েছে, তারাই পানি সরবরাহ করে স্কুলে। কিন্তু স্কুলের টিউবওয়েল অন্য কাউকে দেওয়া উচিত কি না, জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর দেননি।