বাগেরহাটে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল চলছে কয়েক বছর ধরে। কমিটি গঠন ও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে সেই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব দিন দিন দৃশ্যমান হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলে অনেক নেতা-কর্মী স্বেচ্ছায় দল ত্যাগও করেছেন। এমনকি জেলা পর্যায়ের রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে নিজেদের মধ্যে মারামারির ঘটনাও ঘটেছে। দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীসহ যেকোনো কর্মসূচিও পৃথকভাবে পালন করছে দুটি গ্রুপ। এই অবস্থায় ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে অভ্যন্তরীণ কোন্দল মিটিয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। 

জেলার বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক নেতা-কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক দশক ধরে দায়িত্বে থাকা বাগেরহাট জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এমএ সালামকে অব্যাহতি দিয়ে ২০১৯ সালের ২১ ডিসেম্বর দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় থাকা এটিএম আকরাম হোসেন তালিমকে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক করা হয়। ৩৫ সদস্যের এই আহ্বায়ক কমিটিতে সাবেক জেলা কমিটির সভাপতি এমএ সালামকে এক নম্বর সদস্য পদে রাখা হয়। মূলত এরপরই দলের মধ্যে স্পষ্ট দুটি গ্রুপ তৈরি হয়। 

কেন্দ্র ঘোষিত নতুন আহ্বায়ক কমিটিকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করে এমএ সালাম ও তার অনুসারীরা কমিটি প্রত্যাখ্যান করে বিক্ষোভ করেন। এরপর থেকেই বিভিন্ন সভা-সমাবেশে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দেওয়া শুরু করে সালাম ও তালিম গ্রুপ। জেলা নেতাদের এমন কর্মকাণ্ডে ক্রমান্বয়ে দুর্বল হতে থাকে জেলা বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম। এছাড়া বাগেরহাট জেলা যুবদল, ছাত্রদল, শ্রমিক দল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও মহিলা দলের কমিটি নিয়েও দুই গ্রুপের মধ্যে প্রকাশ্যে কোন্দল রয়েছে। 

২০১৮ সালের ৫ জুন জেলা ছাত্রদলের আংশিক কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্র। কিন্তু কমিটিকে জেলা বিএনপির তৎকালীন সভাপতি এম এ সালামের পকেট কমিটি বলে উল্লেখ করে ছাত্রদলের পদ বঞ্চিতদের একটি অংশ। এ সময় তারা এম এ সালামের কুশপুতুলও দাহ করেন।

২০১৮ সালের ৪ জুলাই বাগেরহাট জেলা যুবদলের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। ছাত্রদলের দুই নেতা হারুন আল রশিদকে সভাপতি ও মোল্লা সুজাউদ্দিন সুজনকে সাধারণ সম্পাদক করে জেলা যুবদলের পাঁচ সদস্যের নতুন ওই কমিটি ঘোষণা করা হয়। তবে ঘোষণার পর-পরই কমিটির জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি নাজমুল হুদা এবং সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম সাজ্জাদ হোসাইন পদত্যাগ করেন।

সবশেষ ২০২১ সালের ১৩ নভেম্বর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সভায় বিএনপির বিদ্রোহী গ্রুপের হামলার ঘটনা ঘটে। সাবেক সভাপতি এম এ সালামের নির্দেশে এই হামলার ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ করেছিলেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক এটিএম আকরাম হোসেন তালিম। অবশ্য সেসময়ই এম এ সালাম তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছিলেন।  

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সদর উপজেলার একটি ইউনিয়নের বিএনপির সভাপতি বলেন, কয়েক বছর আগেও বাগেরহাট ছিল বিএনপির ঘাঁটি। কিন্তু এখন জেলার নেতাদের কোন্দলের ফলে সাংগঠনিকভাবেই আমরা দুর্বল হয়ে গেছি। দীর্ঘ দিনেও জোরালো কোনো আন্দোলন করা সম্ভব হয়নি। ফলে দল প্রায় কর্মীশূন্য হয়ে পড়েছে। দ্রুত জেলা পর্যায়ের সমস্যা সমাধান করে প্রান্তিক পর্যন্ত দলকে একত্রিত করতে না পারলে সামনের নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি হবে বলে মনে করেন এই নেতা।

সদর উপজেলার ডেমা ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শেখ আফজাল হোসেন বলেন, প্রায় এক যুগ আগে থেকে সালাম সাহেবের নেতৃত্বে আমরা ঐক্যবদ্ধ ছিলাম। যেকোনো আন্দোলনে হাজার হাজার নেতাকর্মী রাজপথে থাকত। কিন্তু আহ্ববায়ক কমিটি হওয়ার পর স্পষ্ট দুটি দলে বিভক্ত হয়ে যাই আমরা।  

তিনি আরও বলেন, জেলা বিএনপির যিনি আহ্ববায়ক হয়েছেন তিনি ১৯৯৬ সালের পর থেকে দলীয় কার্যক্রমের বাইরে ছিলেন। দলীয় কোনো নেতা-কর্মীর মামলা-হামলাসহ কোনো বিপদে তিনি পাশে ছিলেন না। হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসার মতো দলের দায়িত্ব নিয়েছেন। এই বিষয়টি তৃণমূলের নেতাকর্মীরা মানতে পারেননি। যার ফলে দলীয় শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। 

ষাটগম্বুজ ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হাতে তৈরি এই দলে বিভেদ কখনোই চাই না। এত বছর আমরা ক্ষমতার বাইরে। তারপরেও সিনিয়র নেতৃবৃন্দ পকেট কমিটি করে, এক পক্ষ আরেক পক্ষের নামে অভিযোগ করে। তৃণমূল নেতাকর্মীদের কথা শোনার সময় তাদের নেই। এভাবে কি আর দল চলে বলে হতাশা প্রকাশ করেন তিনি। এছাড়া দ্রুত সমাধান না হলে কমিটি ভাঙা-গড়ার এই খেলা আর নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ রূপ নেবে, যা আন্দোলন–সংগ্রাম তথা জেলা বিএনপির অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে দাবি করেন তিনি। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একাধিক নেতা জানান, জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এম এ সালাম কোনো সাংগঠনিক ব্যক্তি নয়। বিএনপির রাজনীতিতে তার কোনো অবদান নেই। তার বড় ভাই এম এ এইচ সেলিম বাগেরহাট-২ আসনের সংসদ সদস্য এবং জেলা বিএনপির সভাপতি ছিলেন। কিন্তু ওয়ান ইলেভেন (১/১১) এরপরে দীর্ঘ দিন কারাভোগের পরে সেলিম সাহেব রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে পারিবারিক ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে তার ছোট ভাই এম এ সালামকে সভাপতি করেন।

এদিকে ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনের পর থেকে জেলা শ্রমিক দলের সাবেক সভাপতি সরদার লিয়াকত আলী অনেকটা নিষ্ক্রিয় রয়েছেন। 

সরদার লিয়াকত আলী বলেন, দলের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছি। কিন্তু তদবির, সুপারিশ আর অনৈতিক উপায়ে প্রতিবার-ই সুবিধাবাদীরা দলের দায়িত্বে আসেন। এক সময় আন্দোলনে প্রকম্পিত থাকত বাগেরহাটের রাজপথ। অথচ এখন ঘর থেকেই বের হওয়ার সাহস পান না নেতা-কর্মীরা। এই দায় অবশ্যই দায়িত্বে থাকা নেতাদের নিতে হবে। এছাড়া সবাইকে বিভেদ ভুলে যোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে এক পতাকার ছায়াতলে আসতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

জেলা কমিটির সাবেক সভাপতি এম এ সালাম বলেন, দুর্দিনে দলের হাল ধরেছিলাম। যাকে দলের আহ্বায়ক করা হয়েছে তিনি দীর্ঘ দিন ধরে রাজনীতির বাইরে ছিলেন। এছাড়া কমিটিতে স্থান পাওয়া অনেক নেতা নিষ্ক্রিয় ও প্রবাসী। বিগত দিনে কেন্দ্র কোনো কর্মসূচি দিলে সে সময়ে তাদের কাউকে পাশে পাওয়া যায়নি। তাই সাধারণ নেতা-কর্মীরা তার ডাকে সাড়াও দিচ্ছেন না। দলের স্বার্থে স্বল্প সময়ের মধ্যে যোগ্য নেতা দিয়ে পূর্ণাঙ্গ জেলা কমিটি গঠনের দাবি জানান তিনি।

বর্তমান কমিটির আহ্বায়ক এ টি এম আকরাম হোসেন তালিম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির বাগেরহাট জেলা কমিটি কুক্ষিগত করে রাখা হয়েছিল। পরে দেশনায়ক তারেক জিয়ার নির্দেশেই ত্যাগীদের নিয়ে আহ্ববায়ক কমিটির অনুমোদন দেওয়া হয়। এই কমিটি বাগেরহাটে দলকে সাংগঠনিকভাবে পূর্বের চেয়ে আরও শক্তিশালী করেছে। তবে সাংগঠনিক কার্যক্রম প্রায় স্থবির স্বীকার করে তিনি এর কারণ হিসেবে ক্ষমতাসীন দল ও প্রশাসনের বানোয়াট মামলা ও হামলাকে দায়ী করেন। 

তানজীম আহমেদ/এসপি