রংপুরে সবজি খেতে সেচ দিতে দিন দিন বাড়ছে সৌরচালিত পাতকুয়ার ব্যবহার। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিকল্প সেচ সুবিধার লক্ষ্যে পাতকুয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)। পাতকুয়ার মাধ্যমে সেচ দেওয়ায় চাষিদের মাঝে স্বস্তি ফিরে এসেছে।

মাত্র ২০০-২৫০ টাকায় এক বিঘা রবিশস্যের খেতে সেচ দিতে পারছেন চাষিরা। এতে একদিকে যেমন উৎপাদন খরচ কমছে, অন্যদিকে ভূ-উপরিস্থ পানির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত হচ্ছে। সঙ্গে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা হচ্ছে।

বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) বলছে, জেলার বিভিন্ন উপজেলায় সবজি চাষাবাদে গুরুত্ব দিয়ে ১৭টি পাতকুয়া নির্মাণ করেছে। এতে প্রায় ৬৮০ বিঘা জমি সাশ্রয়ী সেচের আওতায় এসেছে। উপকৃত হয়েছেন দেড় হাজারের বেশি চাষি।

বিএমডিএ’র মিঠাপুকুর উপজেলা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলার রানীপুকুর ইউনিয়নসহ বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন সবজি চাষের জন্য প্রসিদ্ধ। এখানকার সবজি চাষি ও ব্যবসায়ীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে উৎপাদিত সবজি নিয়ে যান। কিন্তু জ্বালানি তেলের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী থাকায় তাদের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে সাশ্রয়ী সেচ সুবিধার অংশ হিসেবে পাতকুয়ার পানি সবজি খেতে ব্যবহার করছেন চাষিরা।

বর্তমানে উপজেলায় ৮টি পাতকুয়ার পানি সবজি খেতে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে মিঠাপুকুর উপজেলায় চারটি পাতকুয়া নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে আরও ২টি নির্মাণাধীন রয়েছে। ইতোমধ্যে রাণীপুকুর ইউনিয়নের মাদারপুর, লতিবপুর ইউনিয়নের জানকীনাথপুর, ভাংনী ইউনিয়নের চাঁদপুর, চেংমারী ইউনিয়নের আবিরেরপাড়া, রামেশ্বরপুর, গোপালপুর ইউনিয়নের ধাপ উদয়পুর ও ময়েনপুর ইউনিয়নের জগদীশপুর গ্রামের ১৬০ জন চাষি পাতকুয়ার পানি দিয়ে চাষবাদ করছেন।

দেখা গেছে, লতিবপুর ইউনিয়নের জানকীনাথপুর গ্রামে পাতকুয়ার পানি দিয়ে সবজি চাষ করছেন কৃষক সাদেকুল ইসলাম। তার জমিতেই পাতকুয়াটি খনন করা হয়েছে। তিনি ২৩ শতক জমিতে শিম ও ২০ শতক জমিতে রসুন চাষ করেছেন। ইতোমধ্যে খেতে দুইবার সেচ দিয়েছেন। এতে কোনো টাকা খরচ করতে হয়নি।

রংপুর জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সবজি চাষ হয় মিঠাপুকুর উপজেলায়। এখানকার সবজির মধ্যে কাঁকরোল, শিম, করলা, পটল, লাউ, শসা, ফুলকপি, আলু, বেগুন, টমেটো, পেঁয়াজ ও রসুন অন্যতম।

একই এলাকার শহিদুল ইসলাম ভুট্টা চাষ করেছেন। তিনিও পাতকুয়ার পানি দিয়ে খেতে সেচ দিচ্ছেন। এর আগে ফুলকপি, আলু, বেগুন, টমেটোসহ বিভিন্ন জাতের সবজি চাষে পাতুকুয়ার পানি ব্যবহার করেছেন তিনি। ওই এলাকায় একটি পাতকুয়া থেকে ৩০-৩৫ জন চাষি জমিতে সেচ দিচ্ছেন। বিনামূল্যে পানি পাওয়ায় আর্থিকভাবে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন বলে জানান সেখানকার চাষিরা।

রানীপুকুর ইউনিয়নের মাদারপুর গ্রামের কৃষক বেলাল মণ্ডলের তিন শতক জমিতে একটি পাতকুয়া রয়েছে। ওই জমির আশপাশে ২৫ বিঘা জমি পাইপের মাধ্যমে পাতকুয়ার সেচের আওতায় এসেছে। সাশ্রয়ী সেচের কারণে ব্যাপক চাহিদা থাকায় বাড়তি ফিতা পাইপ লাগিয়ে আরও ১৫ বিঘা জমিতে সেচের ব্যবস্থা করতে হয়েছে।

কৃষক বেলাল মণ্ডল জানান, নিজস্ব স্যালো মেশিন হলে এক বিঘা জমিতে একবার পানি দিতে চার লিটার তেলের প্রয়োজন হয়। যদি পানি কিনতে হয় তাহলে সেচ বাবদ খরচ আরও বাড়ে। বর্তমানে ডিজেল বিক্রি হচ্ছে ৮১ টাকার ঊর্ধ্বে। ফলে সেচ খরচ বাড়ছে। অথচ পাতকুয়ায় সেচ খরচ তেমন নেই বললেই চলে।

একই এলাকার কৃষক আশরাফ হোসেন বলেন, ষাট শতক জমিতে আগাম আলু আবাদ করেছিলেন। দুবার সেচ দিয়েছিলেন। এজন্য খরচ হয়েছে মাত্র ২০০ টাকা। অথচ পাতকুয়া নির্মাণের আগে একবার সেচ দিতেই ৬৫০-৮০০ টাকা খরচ হতো। তবে জমিতে সেচ কতবার দিতে হবে এটি নির্ভর করে আবহাওয়ার ওপর। যদি বৃষ্টি বেশি হয় তাহলে সেচ কম লাগে। ফাল্গুন চৈত্র-মাসে সেচ একটু বেশি লাগে।

বিএমডিএ মিঠাপুকুর জোনের উপসহকারী প্রকৌশলী রায়হান হাবিব জানান, প্রতিটি পাতকুয়া ১২০ ফুট গভীর করা হয়েছে। কুয়ার ৬২ ফুট নিচে সাবমারসিবল পাম্প বসানো হয়েছে। কুয়ায় ৮৪টি আরসিসি রিং পাত আছে। একটি পাতকুয়া চলে ৫ কিলোওয়াট শক্তি সম্পন্ন আটটি সৌরপ্যানেল দিয়ে। সৌরচালিত পাম্পটির পানি সংরক্ষণে একটি টাওয়ারের ওপর তিন হাজার লিটারের ট্যাংক স্থাপন করা হয়েছে। একটি পাতকুয়া ২৫ বিঘা জমি সেচের জন্য ডিজাইন করা হলেও ব্যাপক চাহিদা থাকায় অধিক জমিতে সেচ দেওয়া হচ্ছে।

রংপুর বিভাগের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান বলেন, এক সময় পাতকুয়ার পানিই ছিল ভরসা। প্রায় প্রতিটি বাড়িতে পাতকুয়া ছিল। খাবার পানি হিসেবে ব্যবহার করাসহ সব ধরনের কাজে ব্যবহার করা হতো। কারণ পাতকুয়ায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা যায়। তবে এখন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে নতুন ধরনের পাতকুয়া ব্যবহার করা হচ্ছে।

বর্তমানে উৎপাদন খরচ সাশ্রয়ী হওয়াতে পাতকুয়া খননের জন্য চাষিদের আগ্রহ বাড়ছে। পর্যায়ক্রমে প্রতিটি উপজেলাতে পাতকুয়ার সংখ্যা বাড়ানো হবে বলেও জানান এই কর্মকর্তা। 

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরআই