পুলিশের উদ্যোগে দুঃখ ঘুচল বাকপ্রতিবন্ধী হবিবর-রূপিয়ার
অক্লান্ত পরিশ্রমের পর দিনশেষে বাড়ি ফিরে হবিবরের কপালে ছিল চিন্তার ভাঁজ। পেট পুরে ঠিকমতো খেতেও পারতেন না। এমনকি ছিল না মাথা গোঁজার ঠাঁই। স্ত্রীকে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে থাকতে হতো। কিন্তু শ্বশুর মারা যাওয়ার পর হারান সেই ঠাঁইটুকু। শেষে স্ত্রীকে নিয়ে একটি পুকুর পাড়ে টংঘর বানিয়ে বসত শুরু করেন।
কাঠের পাটাতন আর চট-প্লাস্টিকের বস্তা দিয়ে ঘেরা ছোট সেই ঘরে থাকতে সব সময় আতঙ্কে থাকতে হতো নিঃসন্তান হবিবর-রূপিয়া দম্পতিকে। কেননা, কুয়াশা-বাতাস, রোদ-বৃষ্টি-ঝড়— সব কষ্টই সহ্য করতে হতো।
বিজ্ঞাপন
তবে এখন থেকে আর এসব কষ্ট করতে হবে না হবিবরকে। তার কষ্ট দূর করতে পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ ও জমিদাতা মোস্তাফিজুর রহমান। ইটের তৈরি পাকা দুই কক্ষের ঘরসহ নিজের নামে জমি হবিবরকে হস্তান্তর করা হয়েছে।
নিঃসন্তান হবিবর রহমান (৩৮) জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলার মাত্রাই চকবলিগ্রামের গোলাম মোস্তাফার ছেলে। তিনি প্রায় সাত বছর আগে হিমাইল গ্রামের মৃত কফিল উদ্দিনের মেয়ে রূপিয়াকে বিয়ে করেন। তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনই বাকপ্রতিবন্ধী।
বিজ্ঞাপন
ঘর পেয়ে খুশিতে আপ্লুত হয়ে হবিবর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এই ঘর ভালো, এখন ভাত খাই ভালো, পানি ভালো, কারেন্ট ভালো। এরপর ভালো করে শুয়ে থাকি।'
তার স্ত্রী রূপিয়া বলেন, ‘কল দিচে (দিছে), পায়খানা দিচে, ঘর দিচে, টিন দিচে, তারপরে কারেন্ট, ফ্যান দিচে। ভাত দিচে, টেকা (টাকা) দিচে, এখন লককে (চুপ করে) শুতে (শুয়ে) আচি। এলা (এগুলো) সব দিচে পুলিশ। আর চিন্তা নাই।'
প্রতিবেশী শাহজাহান সরকার বলেন, তাদের কষ্ট দেখে আমরা পুলিশদের বলি, এদের একটা বাড়ি করে দিলে ভালো হয়। এরপর পুলিশ এসে বেশ কয়েকবার পরিদর্শন করার পর তাদের একটি বাড়ি করে দেয়। এতে তাদের ঘুম, খাওয়া, চলাফেরা সব ভালোই চলছে। মনোয়ারা বেগম বলেন, হবিবর আর রূপিয়ার জায়গা জমি কিছুই ছিল না। তাদের থাকতে দেখে আমাদের খুব কষ্ট হতো। এখন আর সেই কষ্ট হবে না।
মাজেদা বেগম বলেন, তারা কাজ করে এসেও থাকার জায়গা পায় না। এমন পরিস্থিতিতে মোস্তাফিজুর ভাই এই জায়গা দান করে আর পুলিশ ঘর করে দেয়। এখন তাদের দিন ভালোভাবে যায়।
হবিবরকে জমি দান করা ব্যক্তি মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, একটি কাজে থানায় পুলিশের কাছে গিয়েছিলাম। তখন ওসি আমাকে বলেন, প্রতিটি উপজেলায় পুলিশের পক্ষে একজন হতদরিদ্র-গৃহহীনকে বাড়ি করে দেওয়া হবে। আপনি হেল্প করতে পারবেন কি না। হতদরিদ্র-গৃহহীনকে বাড়ি করে দেওয়ার কথা শুনে আমি বাড়ি আসি। এরপর বাবাকে বিষয়টি জানাই। আমার বাবা এক বাক্যে রাজি হন এবং বলেন, এমন কাজ মানুষের ভাগ্যে আসে না। এই সুযোগটা কাজে লাগাও। বাবার অনুমতি পাওয়ার পর আমি থানার ওসি (সদ্য বিদায়ী) সেলিম মালিকের সাথে বসলাম। আমার জমির আড়াই শতক হবিবরকে রেজিস্ট্রি করে দিলাম। এরপর বাংলাদেশ পুলিশ সেখানে একটি আধুনিক-মানসম্মত সুন্দর একটি বাড়ি নির্মাণ করে। এ উপকার করতে পেরে আমি অত্যন্ত গর্বিত ও আনন্দিত।
এদিকে জয়পুরহাট সদর উপজেলার কুঠিবাড়ী ব্রিজের উত্তর পার্শ্বের বাসিন্দা সোনালী বেগম (৪০)। তার বাবা অন্যের জমিতে কাজ করে সংসার চালাতেন। তার মা ছিলেন মানসিক প্রতিবন্ধী। তার বয়স যখন ৩ বছর, তখন মা মারা যান। ৬ বছর বয়স থেকে অন্যের বাসায় কাজ করতে থাকেন সোনালী। ১০ বছর বয়সে বাবা অসুস্থ হয়ে চিকিৎসার টাকার অভাবে মারা যান।
পরে জয়পুরহাট শহরের হাতিল গাড়িয়াকান্তের মৃত মতিউর রহমানের ছেলে হারুন অর রশিদের সঙ্গে সোনালী বেগমের বিয়ে হয়। বিয়ের পর তাদের সংসারে দুই কন্যাসন্তান আসে। বড় মেয়ের বয়স ৯ বছর ও ছোট মেয়ের বয়স ৭ বছর হতে দ অসুস্থ হয়ে চিকিৎসার অভাবে মারা যায় হারুন। তারপর দুই সন্তানকে নিয়ে খুব কষ্টে জীবনযাপন করছিলেন সোনালী। সন্তানের লেখাপড়া খরচ চালানোর জন্য মানুষের বাড়ী বাড়ী কাজ করছেন। বিক্রি করছেন সিদ্ধ ডিম। এমন অসহায় গৃহহীন-হতদরিদ্র সোনালীকেও বাড়ি করে দিয়েছে পুলিশ।
দৃষ্টিনন্দন বাড়ি পেয়ে অশ্রুসিক্ত সোনালী ঢাকা পোস্টকে বলেন, জয়পুরহাট থানা গেটের সামনে আমার স্বামী একটি চায়ের দোকান চালাত। সেই দোকানের টাকায় আমাদের সংসার চলত। কিন্তু হঠাৎ স্ট্রোক করে আমার স্বামী মারা গেলে আমি দুই মেয়েকে নিয়ে অসহায় হয়ে যাই। তখন মানুষের বাসায় কাজ করি। তাতেও দিন চলে না। স্বামী বেঁচে থাকতে একটি জমি কিনেছিল। জানতে পারি জায়গা থাকলে পুলিশ ঘর করে দেবে। তখন একটি আবেদন করি। এই আবেদনের পর যাচাই করে পুলিশের পক্ষ থেকে রাস্তা, বিদ্যুৎ, টিউবওয়েরসহ আমাদের একটি বাড়ি করে দেওয়া হয়।
শুধু হবিবর ও সোনালীই নন, তাদের মতো হতদরিদ্র ক্ষেতলাল উপজেলার কুসুম শহর গ্রামের গৃহকর্মী মাহফুজা (৪৮), পাঁচবিবি উপজেলার পাঁচগাছী গ্রামের শামসুন্নাহার (৪০) এবং আক্কেলপুর উপজেলার হাস্তাবসন্তপুর জিয়ানীপাড়ার মোছা. রশিদাকে (৬৩) পাকা বাড়ি করে দিয়েছে পুলিশ। এর মধ্যে সোনালীর জমি ছিল। তা ছাড়া অন্য চারজনকে জমিসহ ঘর দেওয়া হয়েছে।
‘বাংলাদেশে একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না' প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন নির্দেশনা বাস্তবায়নের সহায়ক হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশ প্রধান ড. বেনজীর আহম্মেদের উদ্যোগে মুজিব বর্ষের উপহার হিসেবে তাদের জমিসহ ঘর দিয়েছে জয়পুরহাট জেলা পুলিশ।
জয়পুরহাট পুলিশ সুপার মাছুম আহাম্মদ ভূঞা ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতি থানায় বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে একজন গৃহহীনকে ঘর উপহার দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেন আইজিপি মহোদয়। এরই অংশ হিসেবে আমরা জেলার পাঁচ উপজেলায় পাঁচ অসহায় ও দুস্থ পরিবারকে ঘর উপহার দিই। ইতিমধ্যে পরিবারগুলো ঘরে বসবাস শুরু করে।
তিনি আরও বলেন, এর মাধ্যমে তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উত্তরণ ঘটেছে। এই উদ্যোগে সম্পৃক্ত হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি।
এনএ