আওয়ামী লীগ পরিবারে বেড়ে উঠলেও সদ্য ঘোষিত ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি কাজী রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণের ছোটবেলা থেকে রাজনৈতিক চেতনা ছিল ভিন্ন। বাবা-দাদার আওয়ামী লীগের রাজনীতির চর্চার বিপরীতে গিয়ে তিনি যোগ দেন ছাত্রদলের রাজনীতিতে। আওয়ামী লীগ নেতার ছেলে বিএনপির রাজনীতি করবে, বিষয়টি শ্রাবণের বাবাও মোটেও ভালোভাবে নেননি। এ কারণে ছেলের সঙ্গে ইতোমধ্যেই ছিন্ন করেছেন সম্পর্ক।

রোববার (১৭ এপ্রিল) বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় শ্রাবণের ছাত্রদলের সভাপতি হওয়ার বিষয়। তাই আওয়ামী লীগের পরিবারের সন্তান হিসেবে ছাত্রদলের শীর্ষ পদ পাওয়ায় কেশবপুরে তৈরি হয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা।

এক যুগের বেশি সময় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও রাজনৈতিক চেতনা থেকে সরে আসেননি শ্রাবণ। তাই তো রাজনৈতিক আদর্শের জন্য পরিবার-পরিজন ত্যাগের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করা শ্রাবণকে পুরস্কৃত করেছে বিএনপি। ছাত্রদলের আগামীর কাণ্ডারীর গুরুদায়িত্ব পালন করা শীর্ষ পদটি বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা তুলে দিয়েছেন তার হাতে, এমনটা মনে করছেন তার জন্মস্থান কেশবপুরবাসী।

তবে ভিন্ন রাজনৈতিক চেতনার কারণে পরিবারের কারও সঙ্গে শ্রাবণের সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেছেন শ্রাবণের পরিবার। আর এটিকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন কেশবপুর আওয়ামী লীগের নেতারা। তারা বলছেন, শ্রাবণের রাজনৈতিক চেতনা কেশবপুরে সুস্থ রাজনৈতিক ধারা অব্যাহত রাখতে ভূমিকা রাখবে।

কাজী রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণের গ্রামের বাড়ি যশোরের কেশবপুর উপজেলার চিংড়া গ্রামে। উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী রফিকুল ইসলাম ও কাজী রশিদা দম্পতির ছয় সন্তানের মধ্যে শ্রাবণ সবার ছোট।

শ্রাবণের বাকি তিন ভাইও রাজনীতিতে জড়িত। বড় ভাই কাজী মুস্তাফিজুল ইসলাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। মেজ ভাই কাজী মুজাহিদুল ইসলাম পান্না উপজেলা যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক। আর সেজ ভাই কাজী আজাহারুল ইসলাম মানিক উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক।

শ্রাবণ ২০০৩ সালে কেশবপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। তিনি থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে। কিছুদিনের মধ্যেই ছাত্রদল কর্মী হিসেবে হল ও বিভাগের সহপাঠীদের মধ্যে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন তিনি। ২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বরে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সম্মেলনে সভাপতি প্রার্থী ছিলেন তিনি। সেই সময় আওয়ামী লীগ নেতার ছেলে ছাত্রদলের সভাপতি প্রার্থী হওয়া নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। ওই সম্মেলনে ভোটে হেরে তিনি সিনিয়র সহসভাপতি মনোনীত হন।

সর্বশেষ গত রোববার শ্রাবণ ছাত্রদলের সভাপতি হওয়ার খবর প্রকাশ হলে যশোরসহ তথা জন্মস্থান কেশবপুরের রাজনৈতিক মহলে প্রধান আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠেন তিনি। এ ঘটনাকে এক পরিবারের মধ্যে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সহাবস্থান হিসেবে দেখছেন অনেকে। তবে ছেলের এই রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে উচ্ছ্বাস দেখাননি শ্রাবণের বাবা যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী রফিকুল ইসলাম।

উপজেলা আওয়ামী লীগের এই সহসভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বলেন, ছেলেকে তো আর অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। ভিন্ন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় ছেলের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। এক যুগের বেশি সময় আমাদের সঙ্গে কথা হয়নি, বাড়িতে আসেনি। সে এত দূর এসেছে, তার নিজস্ব প্রচেষ্টায়। আমরা তাকে কোনো সময় অর্থনৈতিক সাপোর্ট দিইনি। জেলার আওয়ামী লীগ বা বিএনপির কেউ তাকে সাপোর্ট দেয়নি। দেশের সব দলের রাজনীতি উদাহরণ আছে, একটি পরিবারে অনেকেই ভিন্নমতের রাজনীতি করতে। সেই ধারাবাহিকতায় শ্রাবণ তার নিজ মতের সঙ্গে তার দল করে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি ও আমার বাবা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাজনীতি করেছি। আমরা পারিবারিকভাবেই আওয়ামী লীগের রাজনীতি এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আদর্শিত। শ্রাবণ যখন ভিন্ন দলের রাজনীতি শুরু করল, তাকে অনেকবার বুঝিয়েছি। সে কথা না শুনে ছাত্রদলে যোগ দিল। তারপর তার লেখাপড়া টাকা দেওয়া বন্ধ করি, তাতেও কোনো কাজ না হওয়ায় তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করি। বর্তমান অবধি এখন সেই সম্পর্ক ছিন্ন রয়েছে। এখন পরিবার থেকে দূরে আছে সে। এমনকি ঈদ, পারিবারিক কোনো অনুষ্ঠান বা বড় বোনের বিয়েতেও অংশ নেয়নি।

শ্রাবণের বড় ভাই কাজী মাজহারুল ইসলাম বলেন, শ্রাবণ বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হয়, তারপর থেকে আমাদের পরিবারের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তারপরও আওয়ামী লীগের একটি পক্ষ বলে বেড়ায় আমাদের পরিবার বিএনপির লোকজনের সঙ্গে জড়িত। আমাদের পরিবারের বাকি সবাই আওয়ামী লীগ করলেও সে তার নিজস্ব চিন্তা-চেতনায় রাজনীতি করে।

গত ১৭ এপ্রিল শ্রাবণ ছাত্রদলের নতুন কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার খবর ছড়াতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। তবে তার স্কুল-কলেজের বন্ধুরা এটিকে কেশবপুরে রাজনৈতিতে সুস্থ ধারা অব্যাহত রাখবে বলে মনে করছেন।

তার দীর্ঘদিনের সহপাঠী মনিরুল ইসলাম বলেন, শ্রাবণ কলেজজীবন থেকে কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। আমরা তাকে কখনো কোনো দলের মিছিল-মিটিং করতে দেখিনি। যদিও সে পড়াশোনার কারণে ঢাকায় গিয়ে ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। শ্রাবণের পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত; আর শ্রাবণ বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বিষয়টিকে আমি ইতিবাচকভাবেই দেখছি।

আদর্শিকভাবে যে কেউ যেকোনো দল করতে পারে জানিয়ে মনিরুল বলেন, প্রত্যেকের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য আছে। সেখান থেকেই যে কেউ যেকোনো দল বা গোষ্ঠীর সাপোর্ট দিতে পারে।

উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আমজাদ হোসেন বলেন, শ্রাবণ পরিশ্রমী ও কর্মীবান্ধব ত্যাগী নেতা। পরিবার-পরিজন ছেড়ে ছাত্রদলের আদর্শ মেনে রাজনীতি করার কারণে তার পরিবার তাকে সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয়। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি পরিবারছাড়া। তাই বিএনপির শীর্ষনেতারা পুরস্কারস্বরূপ শ্রাবণকে ছাত্রদলের শীর্ষ পদ দিয়েছেন। আমরা কেশবপুরবাসী খুবই খুশি।

উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক আজিজুর রহমান বলেন, কাজী শ্রাবণের পরিবার সবাই আওয়ামী লীগের শীর্ষ পদধারী নেতা। শ্রাবণও ইচ্ছা করলে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের যেকোনো পদ নিতে পারতেন। উচ্চাবিলাসী জীবন যাপন করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না ভেবে বিএনপির দুর্দিনের সহযোগী সংগঠন ছাত্রদলে যোগ দিয়েছেন। এরপর বিভিন্ন মামলা, হত্যার হুমকি কারাভোগ করে ছাত্রদলের পরীক্ষিত নেতা হয়েছেন। ছাত্ররাজনীতির জন্য পরিবার-পরিজন ছেড়ে দেওয়া, এত বড় ত্যাগের বিনিময়ে আজ তিনি ছাত্রসংগঠনের শীর্ষ পদ পেয়েছেন। আমরা মনে করি তার হাত দিয়েই ছাত্রদল সুসংগঠিত হবে।

উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মশিয়ার রহমান বলেন, এ দেশের রাজনীতিতে একই পরিবারে বিভিন্ন মতাদর্শের রাজনীতির লোক রয়েছে। তারা নিজ আদর্শের মতে দল পরিচালনা করে। শ্রাবণ ত্যাগী ও পরিশ্রমী ছাত্রদলের কর্মী বলেই আজ দল তাকে ছাত্রদলের দায়িত্ব দিয়েছে। তাকে দায়িত্ব দেওয়ার পর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন অপ্রচার চালাচ্ছেন। আমরা তাদের সেই অপপ্রচারে কান দিচ্ছি না। বিএনপি চলবে বিএনপির আদর্শে। নিজ গ্রামের ছেলে শ্রাবণ ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় এলাকায় খুশির জোয়ার বইছে। কেশবপুর শহর এবং বিভিন্ন গ্রামে আনন্দ মিছিল বের করে উপজেলা ছাত্রদল। মিছিল শেষে মিষ্টিমুখের আয়োজন করে।

কেশবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গাজী গোলাম মোস্তফা বলেন, রাজনীতি করার অধিকার সবার আছে। পরিবারের সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতি করলেও শ্রাবণ ছাত্রকাল থেকেই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এতে দোষের কিছু নেই। শ্রাবণ ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছে, এটাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি। এ বিষয়টি নিয়ে আমাদের দলে কোনো মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে বলে মনে হয় না।

তবে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সভাপতি হয়ে উপজেলার রাজনীতিতে কোনো প্রকার প্রভাব দেখালে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির কর্মীরা প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রতিহত করতে প্রস্তুত রয়েছে বলে জানান এই নেতা।

এনএ