হিরোক। বয়স ২২ বছর। দুটি হাত আর দুটি পা চিরতরে পঙ্গু। সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারেন না। পারেন না স্থির বসে থাকতে। স্পষ্ট করে কথাও বলতে পারেন না। হ য ব র ল বাকশক্তি। চিরাচরিত নিয়মানুযায়ী হিরোকের অন্যের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার কথা। অথচ ঘটেছে তার বিপরীত। 

প্রতিবন্ধী হয়েও মা ও ভ্যানচালক মামার সংসার চালাচ্ছেন হিরোক। তার ওপর নির্ভরশীল দুই পরিবারের অন্তত আটজন। পরের কাছে হাত পেতে যা আয় হয় তা দিয়েও তাদের প্রতিদিনের খাবারের যোগান দেন এই হিরোক। শুধুমাত্র প্রতিবন্ধী ভাতা ছাড়া তার কপালে জোটেনি কোনো সরকারি সহায়তা।

হিরোক মেহেরপুরের গাংনীর কাথুলী ইউনিয়নের মাইলমারী গ্রামের জুনিরুল ইসলামের ছেলে। তার জন্য সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানদেনদের সহযোগিতা কামনা করেছেন স্থানীয়রা।

হিরোকের জন্ম ২০০০ সালে। হিরোকের বয়স যখন ৪ বছর, তখন অভাবের সংসারের খরচ যোগাতে প্রতিবন্ধী হিরোক, তার ছোট ভাই সজিব ও মা ছামিরন নেছাকে গাংনীর শিশিরপাড়া গ্রামে রেখে বাবা জুনিরুল ইসলাম রিকশা চালাতে যান ঢাকা শহরে। এরপর আর বাড়ি ফেরেননি তিনি। খোঁজও নেননি পরিবারের। তিনি বেঁচে আছেন কিনা তাও অজানা। তবে তিনি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন- এমন খবর জানে পরিবারের সবাই। দুই সন্তান নিয়ে দিশেহারা মা ছামিরন নেছা। তাদের খাবারের যোগান দিতে অন্যের বাড়িতে কাজ নেন ছামিরন। মায়ের কষ্ট বুঝতে পেরে হিরোক বেছে নেন ভিক্ষার পথ। প্রতিদিন সকালে বিভিন্ন বাজারে রেখে আসতো মা। আবার সন্ধ্যায় বাড়ি নিয়ে আসতো। এভাবেই শুরু প্রতিবন্ধী হিরোকের জীবনযুদ্ধ।

হিরোক অন্যের সাহায্যে চললেও ছোট ভাই সজিবকে স্কুলে পাঠাতে ভুল করেনি। সজিব এখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। হিরোক এক প্রতিবেশী মামা আজিজুলের ভ্যানে চড়ে সাহায্যের জন্য ঘুরে বেড়ান গ্রাম থেকে শহর। সারাদিনে যে আয় হয়, তা দিয়ে চলে হিরোক ও ভ্যানচালক মামা আজিজুলের সংসার।

হিরোকের হাত পা সবই প্রায় অচল। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখন কোনো গাছের ছায়ায় শুয়ে পড়েন। সারাদিনের রোজগারের টাকা বাড়িতে এনে তুলে দেন মায়ের হাতে। মা কোলে করে নামিয়ে গোসল করান, প্যান্ট পরান। প্লেটে খাবার গুছিয়ে দিলে চামচের মাধ্যমে পা দিয়ে নিজেই খেতে পারেন হিরোক। তার একটি অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন রয়েছে। ইন্টারনেটেও তিনি পারদর্শী। পায়ের সাহায্যে ফেসবুক আর ইউটিউব দেখে সময় কাটে তার।

হিরোকের জীবনযুদ্ধের গল্প শুনতে তাদের বাড়িতে গেলে মা ছামিরন নেছা জানান হৃদয় বিদারক ঘটনা।

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, হিরোক জন্ম থেকেই প্রতিবন্ধী। যখন তার বয়স চার বছর আর ছোট ছেলে সজিবের বয়স দুই, তখন এলাকায় প্রচণ্ড অভাব। সংসার চালানো খুবই কষ্টকর। হিরোকের বাবা জুনিরুল ইসলাম একটি ছাগল বিক্রি করে ঢাকা শহরে যায় রিকসা চালিয়ে টাকা পাঠাবে বলে। সেই থেকে আর কোনো খোঁজ নেইনি, বাড়িতেও ফেরেনি। শুনেছি সড়ক দুর্ঘটনায় নাকি মারা গেছে। দিশেহারা হয়ে মাইলমারি গ্রামে বাবার সংসারে চলে আসি। বাবা-ভাইদের সংসারেও অভাব। অন্যের বাড়িতে কাজ করে নিজে বেঁচে থেকে সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে হয়েছে। হিরোক আমার বড় ছেলে। তার হাত-পা সবই অচল। কিন্তু বিবেক আর বুদ্ধিমত্তা প্রখর। তার উপার্জিত আয়ে আমাদের সংসার চলে। ছোট ছেলে স্কুলে পড়ে। সরকারিভাবে প্রতিবন্ধী ভাতা আছে বলে চেয়ারম্যান-মেম্বাররা ঘুরেও দেখে না।

প্রতিবন্ধী হিরোক ভাঙা কণ্ঠে বলেন, আমার জীবনে আমার মা-ই সব।  ছোট ভাইকে লেখাপড়া করাইছি। সে একদিন আলাদা হয়ে যাবে। আমার মা না থাকলে আমি বিছানা থেকে উঠতে পারবো না। গোসল করতে পারবো না। খেতেও পারবো না। আমাকে দেখবে কে? একথা বলতেই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে তার।

হিরোকের নানা আতাহার আলী বলেন, আমার অভাবের সংসার। ছোটবেলায় হিরোকের বাবা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে ঢাকায় যাওয়ার কথা বলে। আর বাড়ি ফেরেনি। হিরোকই একমাত্র সংসারের উপার্জনের মাধ্যম। হিরোক শারীরিক প্রতিবন্ধী হলেও তার বুদ্ধিমত্তার জোরে সংসারে সুখ এসেছে।

হিরোককে সঙ্গে নিয়ে গ্রাম থেকে শহর ঘুরে বেড়ানো ভ্যানচালক মামা নুরাল মিয়া বলেন, খুব সকালে তাকে ভ্যানে করে বিভিন্ন গ্রামে কিংবা শহরে নিয়ে যাই। হিরোকের অবস্থা দেখে অনেকেই সহযোগিতা করেন। প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা পাওয়া যায়। এ টাকা সমান ভাগে ভাগ করা হয়। এতে হিরোক ও আমাদের সংসার চলে। তবে রোজার মাসে একটু বেশি টাকা পাওয়া যায়।

প্রতিবেশী আশরাফুল ইসলাম বলেন, হিরোক প্রতিবন্ধী। তার যেভাবে সহযোগিতা পাওয়া প্রয়োজন তা কিছুই পায় না। চেয়ারম্যান-মেম্বারদের কাছ থেকে ভিজিডি, ভিজিএফের সাহায্য সুস্থ ও সবল মানুষ পায়, কিন্তু হিরোক পায় না। এটা খুবই দুঃখজনক।

স্থানীয় ইউপি সদস্য কাবের আলী বলেন, আমি নতুন মেম্বার হয়েছি। আগের মেম্বার কী করেছেন তা জানি না। তবে আমি আমার সাধ্য অনুযায়ী হিরোককে সহযোগিতা করব।

কাথুলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান রানা বলেন, এমন একজন সংগ্রামী প্রতিবন্ধীর কথা আমি জানতাম না। হিরোক যেহেতু প্রতিবন্ধী, ভিক্ষা না করেও সে যাতে অন্য কিছু করে জীবনযাপন করতে পারে সে ব্যাপারে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আরএআর