আড়াই যুগ ধরে যেভাবে জনপ্রিয়তায় দৈনিক মাথাভাঙ্গা
দৈনিক মাথাভাঙ্গার পাঠকপ্রিয়তা সংবাদপত্রজগতে শুধু ঈর্ষণীয় নয়, গবেষণারও বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মফস্বলের একটি ছোট্ট জেলা শহর থেকে প্রকাশিত পত্রিকাটি আড়াই যুগ ধরে আঞ্চলিক মুখপত্র হয়ে ওঠার রহস্য কী? এই দৈনিকের সম্পাদকের সাফ জবাব, নির্দলীয় ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনই মূলমন্ত্র।
ন্যায়ের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়ে কুসংস্কারমুক্ত সমাজ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালনে নির্লোভ একদল কলমসৈনিককে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে পৌঁছে দিয়েছে চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ ও কুষ্টিয়ার একাংশের অসংখ্য পাঠক মহলের হৃদয়ের মণিকোঠায়। মূলত চুয়াডাঙ্গার বুক চিরে বয়ে যাওয়া মাথাভাঙ্গা নদীর নামেই এই পত্রিকার নামকরণ।
বিজ্ঞাপন
১৯৯১ সালের প্রথম দিকে যখন নির্দলীয় প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন হয় দেশে, তখন চুয়াডাঙ্গা সাহিত্য পরিষদের আঙিনায় সাহিত্য নিয়ে আড্ডা দেওয়া চার যুবক স্বপ্ন দেখেন পত্রিকা প্রকাশের। স্বপ্নের বাতাবরণ সাংবাকিতা থেকেই। সরদার আল আমিন, আলী কদর পলাশ, রিচার্ড রহমান ও পাঞ্জু যখন দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের বিষয়টি আলোচনায় আনেন, তখন বিষয়টি অনেকের কাছেই হাস্যরসের খোরাক হয়। সরদার আল আমিন হন প্রকাশক।
প্রথম প্রস্তাবিত সংখ্যা প্রকাশিত হয় ওই বছরের ২৬ মার্চ। এ সংখ্যার সম্পাদক ছিলেন অধ্যক্ষ হামিদুল হক মুন্সি। তাকেই সম্পাদক নিযুক্ত করে প্রকাশক মালিক মুদ্রাকর সরদার আল আমিন পত্রিকা প্রকাশের ছাড়পত্র নেওয়ার জন্য আবেদন করেন। হামিদুল হক মুন্সি তখন পৌর ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। একজন অধ্যক্ষ একটি পত্রিকার সম্পাদক হতে পারেন কি না, প্রশ্ন তুলে ছাড়পত্রের ফাইল পড়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে।
বিজ্ঞাপন
তখনই ওই চার যুবকের পাশে দাঁড়ান তৎকালীন চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম পিনু। পরে তাকে সম্পাদক করা হয়। ছাড়পত্র মেলে। পত্রিকার অনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৯১ সালের ১০ জুন। সন্ত্রাস, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা দূর করে সুন্দর সমাজ গঠনের প্রত্যয়ে ‘মাথাভাঙ্গা’ পরিবারের অগ্রযাত্রায় শামিল হন একদল টগবগে যুবক।
বহু চড়াই-উতরাই পার হয়েছে। হাল ছাড়েননি প্রকাশক। তিনি পরবর্তী সময়ে ভারপ্রাপ্ত এবং বর্তমানে সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বার্তা সম্পাদক হিসেবে রয়েছেন আহাদ আলী মোল্লা। যাকে সাহিত্যানুরাগীরা ছড়া সম্রাট উপাধিতে ভূষিতও করেছেন। দৈনিক মাথাভাঙ্গা প্রকাশের সেই প্রথম দিন থেকে অর্থাৎ ৩০ বছর ধরে টিপ্পনী নামে সচেতনতামূলক ছড়ার কলাম লিখে আহাদ আলী মোল্লা যে দৃষ্টান্ত গড়েছেন, তাও আজ ইতিহাস। টিপ্পনী মাথাভাঙ্গা পত্রিকার পাঠকদের কাছে অনেকটা চাটনি।
দৈনিক মাথাভাঙ্গা পত্রিকা প্রচারসংখ্যা অবিশ্বাস্য রকমের বেশি। প্রতিদিন ভোরে দৈনিক মাথাভাঙ্গা ছাপাখানা সচিমা প্রিন্টার্সের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়ালেই প্রমাণ মিলবে। অসংখ্য বিক্রয় প্রতিনিধি, অসংখ্য পরিবহন সারিবদ্ধভাবে পত্রিকা নিয়ে ছোটেন শহর-শহরতলি, গ্রাম-গ্রামান্তর। চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরের এমন একটি গ্রামও খুঁজে পাওয়া যাবে না যে গ্রামে এই পত্রিকা পাওয়া যাবে না।
এত পাঠক হলো কীভাবে? পাঠকপ্রিয়তা পাওয়ার মূলমন্ত্র কী? সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক, ব্যবস্থাপক, বিতরণ বিভাগে কর্মরতরা এবং সাংবাদিকরা কীভাবে দায়িত্ব পালন করেন― এসব প্রশ্নে সম্পাদক প্রকাশক সরদার আল আমিন বলেন, যখন আমার বয়স ছিল ২১ বছর দুই মাস। তখন কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে পত্রিকা প্রকাশ করি। অতটুকু বয়সে কত বড় ভার ঘাড়ে নিয়েছি, তা তখন বুঝিনি। যাত্রাপথে অর্জিত অভিজ্ঞতা এবং পাঠকদের পরামর্শ আমাদের তথা ‘মাথাভাঙ্গা’ পরিবারকে করেছে সমৃদ্ধ।
বস্তুনিষ্ঠতায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ শুধু স্লোগান নয়, এটা সব সময় মনে রেখে প্রতিদিন পাঠক মহলের কাঠগড়ায় নিজেদের বিচার করাতে পেরেছি বলেই আমরা সর্বস্তরে সমাদৃত। নিরপেক্ষ নয়, সংগ্রামের ময়দানে ‘ন্যায়পক্ষ’ আমাদের অবস্থান। আমাদের জনপদের ললাটে একসময় সন্ত্রাসকবলিত কালিমা পড়ে। সেই কালিমা মুছতে কতটা ঝুঁকি নিয়ে শক্ত হাতে কলম ধরতে হয়েছে, তা দূরে থাকা অনেকে হয়তো অনুমানও করতে পারবেন না। ভাইয়ের সামনে থেকে ভাইকে তুলে নিয়ে গেছে অবৈধ অস্ত্রধারীরা। ভাই ভাইয়ের জন্য প্রকাশ্যে অশ্রু ঝরানোর সাহস যখন দেখাতেন না, তখন দৈনিক মাথাভাঙ্গা পত্রিকা বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে।
বহু কঙ্কাল উদ্ধারে মাথাভাঙ্গার অবদান অস্বীকার করার জো নেই। সন্ত্রাসকবলিত জনপদে বাঁচার মন্ত্র? সেটাও সরল। স্বার্থে তাদের পক্ষভুক্ত না হওয়া। তাতে কোনো পক্ষই প্রতিপক্ষ হয় না। ভয়, প্রতারণার দোকান? সুযোগ নেই এই তল্লাটে। মাথাভাঙ্গা পরিবার প্রভাব প্রতিপত্তিশালী কারও তোষামোদ করে না। তাঁবেদারির প্রশ্নই আসে না। এসব যেমন সম্পাদকীয় নীতি এবং দায়িত্বের অংশ, তেমনই পাঠককুল কী চায়, তা বুঝে পাঠকের চাওয়া পূরণের নিরন্তর প্রচেষ্টা পাঠকপ্রিয়তা পাওয়ার অন্যতম কারণ। পত্রিকাটিতে বিজ্ঞাপন দিতে প্রতিদিন লাইনে দাঁড়ান অনেকেই।
সরকারি বিজ্ঞাপনের জন্যও কোনো অফিসে ধরনা দিতে হয় না। তবে সরকারি বিজ্ঞাপনের থেকে ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপনগুলোই বেশি গুরুত্ব দেয় কর্তৃপক্ষ। মূলত পত্রিকা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন সম্পাদক সরদার আল আমিন। তার অন্য কোনো চাকরি বা ব্যবসা নেই। প্রতিদিন নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে পাঠকের হাতে তুলে দেন দৈনিক মাথাভাঙ্গা।
রাতে মাথাভাঙ্গার ডেস্কে কাজ করেন একদল তরুণ সংবাদকর্মী। কেউ ব্যস্ত সংবাদ সংগ্রহে, কেউ সম্পাদনায়। কম্পিউটার অপারেটর ও পেস্টাররাও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন। আর সার্বিক দিক তত্ত্বাবধান করছেন বার্তা সম্পাদক আহাদ আলী মোল্লা।
দিন শেষে পাঠকদের হাতে বস্তুনিষ্ঠ পত্রিকাটি তুলে দেওয়ায় বড় চ্যালেঞ্জ বলে জানান দৈনিক মাথাভাঙ্গায় কর্মরত সংবাদকর্মীরা।
তথ্যবহুল ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের জন্যই দৈনিক মাথাভাঙ্গা চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ ও কুষ্টিয়া এলাকায় খুব জনপ্রিয় বলে জানান পাঠকরা।
আর পত্রিকার বিক্রয় প্রতিনিধিরা অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রতিদিন প্রত্যন্ত অঞ্চলে খুব ভোরেই পৌঁছে যায় দৈনিক মাথাভাঙ্গা। সকাল সকাল পাঠকের কাছে দৈনিক মাথাভাঙ্গা তুলে দিয়ে খুশি তারাও।
দৈনিক মাথাভাঙ্গার বিক্রয় প্রতিনিধিরা জানান, মাথাভাঙ্গা পত্রিকা পাঠকদের প্রতিদিনের চাহিদার শীর্ষে রয়েছে। তাই এর প্রচারসংখ্যাও বাড়ছে দিন দিন।
এনএ