রংপুর অঞ্চলে এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। রাত হলেই বাড়ছে কালো মেঘের ডাকাডাকি। বজ্রপাতসহ ভারী বর্ষণ আর উজানের ঢলে তিস্তা, ধরলা, ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘটসহ বিভিন্ন নদ-নদীতে বেড়েছে পানি। এ কারণে তিস্তাপাড়ে দেখা দিয়েছে বন্যা আতঙ্ক। সেখানকার ডালিয়া তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে পানি বেড়ে বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই করছে।

কিছু কিছু এলাকায় উজান থেকে ধেয়ে আসা ঢল তিস্তা তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে ঢুকে পড়েছে। এতে চরাঞ্চলে চাষ করা বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষকেরা। পানিতে তলিয়ে গেছে নিম্নাঞ্চল। কোথাও কোথাও হাঁটু পানিতে ডুবে আছে ঘর-বাড়িসহ উঠতি ফসল। আর ৩৬ ঘণ্টা বৃষ্টি হলেই তিস্তার পানি বিপৎসীমা ছাড়িয়ে বন্যায় রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন পাউবো।

রোববার (১২ জুন) বেলা ৩টার দিকে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজের ডালিয়া পয়েন্টে পানির প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ৪৮ সেন্টিমিটার। যা (স্বাভাবিক ৫২ দশমিক ৬০ সেন্টিমিটার) বিপৎসীমার মাত্র ১২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, গত এক সপ্তাহের টানা বৃষ্টিপাত আর উজানের ঢলে তিস্তাসহ এ অঞ্চলের অন্যান্য নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এখনো বিপৎসীমা ছাড়িয়ে যায়নি। তবে আর দুই দিন ভারী বর্ষণ হলে বিপৎসীমা ছাপিয়ে এ অঞ্চলের তিস্তা নদী তীরবর্তী এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির সম্ভাবনা রয়েছে।

রোববার দুপুরে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলায় তিস্তানদী বেষ্টিত বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, নদী তীরবর্তী লক্ষীটারী ইউনিয়নের পূর্ব ও পশ্চিম ইচলি, বিনবিনার চর, মহিপুর, মধ্য বিনবিনাহর বেশ কিছু এলাকার নিম্নাঞ্চল ও চরের কোথাও পানি বেশি, আবার কোথাও পরিমাণে কম। হাঁটু পানিতে নিমজ্জিত ফসল বাঁচানোর চেষ্টা করছেন কৃষকরা। কেউ কেউ বন্যা ও ভাঙন আতঙ্কে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেওয়ার জন্য ছুটছেন। আবার কেউ কেউ নদীর কোলঘেষা ঘরবাড়ি সরিয়ে নিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

গঙ্গাচড়ার বিনবিনাসহ আশেপাশের ৫০টি গ্রামে বন্যা এবং ভাঙন ঠেকাতে স্থানীয় চেয়ারম্যান আবদুর রউফের সহযোগিতায় এলাকাবাসীর উদ্যোগে দেওয়া নির্মিত বাঁধটি অবশেষে বাঁচানোর উদ্যোগ নিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। কাজ শুরু হয়েছে। এখন জিও ব্যাগ ফেলার পাশাপাশি বাশেঁর স্পার নির্মাণ কাজ চলছে। বন্যার আগেই এই কাজ শুরু করায় ওই এলাকার মানুষের ভাঁজপড়া কপালে এখন হাসির ঝিলিক। তবে স্থানীয়রা চাইছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের এই কাজে যেন কোনো ধরনের গাফিলতি না করা হয়।

লক্ষীটারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদি জানান, কয়েকদিন ধরে এলাকায় মাইকিং করে নদী তীরবর্তী চর ও নিম্নাঞ্চলের কৃষকদের ধান, ভুট্টা, বাদামসহ অন্যান্য আবাদি ফসল ঘরে তুলে নিতে বলেছেন তিনি। তবে এখন যেভাবে নদীতে পানি বাড়ছে, তা অব্যাহত থাকলে আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে বড় ধরনের বন্যা হতে পারে।

একইভাবে শঙ্কিত কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার চরাঞ্চলের চাষিরা। তারা এই সংকট কীভাবে কাটিয়ে উঠবেন তা ভেবে কূল পাচ্ছেন না।

কাউনিয়া উপজেলার চর এলাকার উঠতি ফসল মরিচ-পেঁয়াজ, মিষ্টি কুমড়া, ধান, তামাক ও ভুট্টাসহ বিস্তীর্ণ চরের প্রায় হাজার একর জমিতে পানি ঢুকে পড়েছে। উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়নের ঢুষমারার চর এলাকার কৃষক বজলার রশিদ বলেন, গেল চৈত্র মাসে তিস্তার পানি বেড়ে আমার অনেক ক্ষতি হয়েছে। ছয় একর জমির ধান, কুমড়া, পেঁয়াজ, রসুন ও বাদাম নষ্ট হয়ে গেছে। এখন আবার আষাঢ় শুরু না হতেই বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে।

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিস্তা, ধরলা, ব্রহ্মপুত্রসহ এ অঞ্চলের বেশিরভাগ নদ-নদীর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। নীলফামারীর ডিমলার ছাতনা এলাকা থেকে জলঢাকা, লালমনিরহাটের পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রৌমারী, রাজারহাট, উলিপুর, চিলমারী, এবং গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের হরিপুরের ব্রহ্মপুত্র নদ পর্যন্ত অববাহিকার ৩৫২ কিলোমিটার এলাকার চরাঞ্চল এবং নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে এই সব এলাকার উঠতি বাদাম, আমনের চারা, পাট, সবজিসহ বিভিন্ন ফসল প্লাবিত হয়েছে। বড় বন্যার আশঙ্কায় আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে তিস্তাপাড়ের মানুষজন।

পরিস্থিতির বেশি অবনতি হয়েছে কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলায়। সেখানকার ৩২টি গ্রামের প্রায় ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ২১টি বিদ্যালয়ে ব্যাহত হচ্ছে পাঠদান। ডুবেছে ১০৭ হেক্টর জমির ফসল। রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় বেড়েছে দুর্ভোগ।

রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান হাবীব জানিয়েছেন, বৃষ্টিপাত এবং উজানের ঢলের কারণে তিস্তায় গত বুধবার রাত ৯টা থেকে পানি বাড়তে শুরু করেছে। ওই সময় থেকে ৫১ দশমিক ৮৩ থেকে বেড়ে রোববার সকাল ৬টায় ৫২ দশমিক ৪৫ সেন্টিমিটারে ছিল। বেলা ১২টায় তা বেড়ে ৫২ দশমিক ৫০ সেন্টিমিটারে গিয়ে পৌঁছে। বিকেল ৩টার দিকে ডালিয়া তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ৫২ দশমিক ৬০ এর মাত্র ১২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।

এদিকে রংপুর আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, গত ৪ জুন শনিবার সকাল ছয়টা থেকে ১২ জুন রোববার সকাল ৬টা পর্যন্ত ১৬৮ দশমিক ৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে এই অঞ্চলে। এর মধ্যে রোববার সকাল ৬টার আগের ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত হয়েছে ৪৮ মিলিমিটার। দুপুরেও বেশ কিছু জায়গায় বৃষ্টিপাত হয়েছে। 

আরআই