জামালপুরের হাতে তৈরি নকশিপণ্যের সুনাম ইতিমধ্যেই দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বাইরে। দেশ-বিদেশে চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে ব্যাপকভাবে প্রসার ঘটেছে এখানকার হস্তশিল্পের। ইতিমধ্যে নকশিকাঁথা জেলা ব্র্যান্ডিংয়ের স্বীকৃতি পেয়েছে। জামালপুরের এই ঐতিহ্যবাহী নকশিশিল্পের গুণগত মান বৃদ্ধি, ব্যবসার প্রসার ও উদ্যোক্তা তৈরিতে বিশেষভাবে কাজ করার লক্ষ্যে শেখ হাসিনা নকশিপল্লি স্থাপনের প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। প্রকল্পটি এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার মনে আশার সঞ্চার করেছে।

জামালপুর জেলায় সব মিলিয়ে কমবেশি ৫০ হাজার নারী কর্মী জড়িত আছেন নকশিশিল্পের সঙ্গে। সুই-সুতায় নানা ডিজাইন, রং আর বর্ণে তারা ফুটিয়ে তুলছেন নকশিকাঁথা, বেডকভার, শাড়ি, ফতোয়া, পাঞ্জাবি, সালোয়ার-কামিজসহ নানা সুচিপণ্য। উন্নত মানের এখানকার নকশি সুচিপণ্য ইতিমধ্যে ঢাকাসহ দেশের সব বড় শহরের বাজার দখল করেছে। একই হারে এই পণ্যের প্রসার ঘটেছে বিদেশেও।

সরেজমিনে জামালপুরের সদর উপজেলার মনিরাজপুর বটতলায় দেখা গেছে, নারীরা পাটিতে বসে বিভিন্ন ধরনের সুচিকর্ম করছেন। নিপুণ হাতে দক্ষতার সঙ্গে সুই-সুতা দিয়ে ফুটিয়ে তুলছেন বাহারি নকশা। এসব তৈরি হলেই পৌঁছে দেবেন ক্রেতার কাছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পণ্যের গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকলে তাদের আরও দক্ষতা বাড়বে। ফলে কাজের মজুরিও বাড়বে। উপার্জন বাড়লে তাদের সংসার আগের তুলনায় আরো ভালো চলবে।

নকশিশিল্পী হোসনে আরা বেগম জানান, ৩০ বছর ধরে আমি এই পেশার সাথে জড়িত আছি। আমার আর্থিক অবস্থা খারাপ। আমি ১৯৯২ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং ইনিস্টিডিউটে মেলা করে ৬৪ জেলার ভেতর প্রথম স্থান গ্রহণ করি। আমি সরকার থেকে কোনো সহায়তা পাইনি। নিজের চেষ্টা ও আমার স্বল্প পুঁজি নিয়ে আজ আমি ২০ থেকে ২৫ জন নারীকে দিয়ে এই কাজ করাই। শুনছি শেখ হাসিনা নকশিপল্লি হবে, সেখানে যদি আমরা একটা দোকান পাই, সরকার যদি আমাদের ঋণ দেয়, আমরা খুবই উপকৃত হব। আমাদের কাজের মান আরও বৃদ্ধি পাবে।

সায়রা হস্তশিল্পের স্বত্বাধিকারী মোহনা আক্তার

আরেক নকশিশিল্পী ফাহিমা জানান, স্বামীর উপার্জনে আমাদের সংসার ঠিকভাবে চলে না। তাই আমরা এই কাজ করি। এখন যে মজুরি পাই, তা দিয়ে আমাদের পোষায় না। শুনছি নকলিপল্লি হবে, নকশিপল্লি হলে আমাদের মজুরি বৃদ্ধি পাবে। আমরা উপকৃত হব। ছেলেমেয়ে নিয়ে ভালোভাবে থাকতে পারব।

তারা আরও জানান, তাদের নিজস্ব কোনো শোরুম বা দোকান নেই। উৎপাদিত এসব পণ্য নিজেদের উদ্যোগে হেঁটে হেঁটে বিক্রি করেন। আবার অনেকে তাদরে কাছ থেকে অর্ডার দিয়ে পছন্দসই পণ্য বানিয়ে নেন। তারা আশাবাদী, শেখ হাসিনা নকশিপল্লি হলে তাদের কষ্ট লাঘব হবে।

উদ্যোক্তারা জানান, নকশিপল্লিতে একই সঙ্গে প্রশিক্ষণকেন্দ্র, শো-রুম ও পণ্য প্রদর্শনীর ব্যবস্থা থাকবে। এতে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরি হবে। প্রত্যেক ক্রেতা তার পছন্দমতো যেকোনো পণ্য যেকোনো শো-রুম থেকে কিনতে পারবেন। পণ্যের গুণগত মান অনুযায়ী দাম নির্ধারণ হবে। ফলে বড় বড় মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ী নয়, ছোট-বড়, নতুন-পুরোনো সব ব্যবসায়ীই লাভবান হবেন। নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে, যেসব উদ্যোক্তা যথার্থ সুযোগ ও পুঁজির অভাবে তাদের ব্যবসার প্রসার ঘটাতে পারছেন না, তারাও বিশেষ সুবিধা পাবেন। এককথায় নকশিপল্লিতেই বিকশিত হবে নকশিশিল্প।

‘জামালপুরের নকশিকাঁথা, বাংলাদেশের গর্বগাথা’ স্লোগান নিয়ে ইতিমধ্যেই জেলা ব্র্যান্ডিং হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে নকশিপণ্য। জেলা ব্র্যান্ডিংয়ের ফলে নকশিপণ্যের উদ্যোক্তাদের মাঝে বেশ সাড়া পড়ে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের ১২ ডিসেম্বর একনেক সভায় শেখ হাসিনা নকশিপল্লির জন্য ৭৭২ কোটি টাকা বিনিয়োগের অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর পরিকল্পনা বিভাগ ২০১৯ সালের ১৪ মে প্রকল্পটির জিও জারি করে। আর ২১ মে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় প্রশাসনিক অনুমোদন দেয়।

গত ২৩ জুন প্রকল্পের অনুকূলে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রকল্পের আওতায় ২৩ জুলাই মন্ত্রণালয় কর্তৃক বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় থেকে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়ার সুপারিশ করা হয়। বরাদ্দকৃত অর্থের বিভাজন অনুমোদনের প্রস্তাব ২৪ জুলাই বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুমোদনের প্রস্তাব ২০১৯ সালের ৫ আগস্টে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। পরিকল্পনা কমিশন প্রকল্পটির অনুকূলে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের নতুন প্রকল্পের বরাদ্দ থেকে ২৯ আগস্ট ১০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়। ১০০ কোটি টাকা অনুমোদন এবং প্রথম কিস্তি বাবদ ১ কোটি ৫৩ লাখ টাকা অবমুক্তকরণ প্রস্তাব ১২ সেপ্টেম্বরে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। 

আরও জানা যায়, শেখ হাসিনা নকশিপল্লির জন্য ৩০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে। এরই মধ্যে জামালপুর সদর উপজেলায় ২০৪ দশমিক ৭৩৫০ একর ও মেলান্দহ উপজেলায় ৯৫ দশমিক ২৬৫০ একর জমি অধিগ্রহণের প্রশাসনিক অনুমোদন পাওয়া গেছে।

সারা বাংলাদেশের যত ধরনের হস্তশিল্প আছে, তার সবগুলোরই হোলসেল মার্কেট হবে এই শেখ হাসিনা নকশিপল্লিতে। অন্তত তিন হাজার ভবন হবে এখানে। চারজন উদ্যোক্তার জন্য একটি করে কারখানা স্থাপনের জন্য ভবন বরাদ্দ থাকবে। তারা তাদের পণ্য তৈরি করবেন সেই জায়গায়। এতে ১২ হাজার উদ্যোক্তার কারখানা থাকবে এখানে। তাদের জন্য থাকবে একটি বিশাল শপিংমল। সেই শপিংমলে প্রতিটি পণ্যের জন্য একটি বা দুটি করে শো-রুম বরাদ্দ দেওয়া হবে।

নকশিপল্লিটি আন্তর্জাতিক মানের হওয়ায় বিদেশি ক্রেতাদের জন্য একটি ফাইভ স্টার মানের হোটেল স্থাপন করা হবে। এর পাশাপাশি এর ভেতরেই একটি পর্যটনকেন্দ্র স্থাপন করা হবে। থাকবে থিমপার্ক। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক হস্তশিল্প মেলা আয়োজনের সব রকমের ব্যবস্থা থাকবে। যাতে জামালপুরের হস্তশিল্প নকশিকাঁথাসহ বাংলাদেশের সব ধরনের হস্তশিল্পের ব্যবসার প্রসার ঘটে।

বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (বাপা) জামালপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ইউসুফ আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, জামালপুরে নকশিপল্লি স্থাপিত হলে হাজার হাজার নারী কর্মীর কর্মসংস্থান তৈরি হবে। কাজের গুণগত মান বাড়বে, নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে। শুধু জামালপুর নয়, সারা দেশের অনেক নারীই এই শিল্পের মাধ্যমে নি

জীবিকা হস্তশিল্পের স্বত্বাধিকারী হালিমা দেওয়ান ঝিনুক 

জের পায়ে দাঁড়াতে পারবেন। এতে জামালপুরের সার্বিক আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন হবে, বিকশিত হবে নকশিশিল্প।

এ বিষয়ে জামালপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক মো. ইকরামুল হক নবীন ঢাকাপোস্টকে জানান, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জামালপুরের নকশিশিল্পের প্রসার ক্রমেই বাড়ছে, আর ব্যবসার প্রসারের সঙ্গে অর্থের চাহিদা বাড়ায় নারী উদ্যোক্তাদের জন্য স্বল্প সুদে ব্যাংকঋণ পাওয়ার দাবি বাস্তবায়নে কাজ করছে চেম্বার অব কমার্স।

সায়রা হস্তশিল্পের স্বত্বাধিকারী মোহনা আক্তার শ্যামা ঢাকা পোস্টকে বলেন, জামালপুরে নকশিপল্লি হলে আমরা আমরা একত্র হয়ে এক জায়গায় থাকলাম। আর বাইরে থেকে যারা আসবে, তারা বিভিন্ন কাপড় দেখতে পাবে। তাতে আমাদের পরিচিতি বাড়বে। বিভিন্ন জায়গায় ছড়াবে অনেক বেশি, জামালপুরের নকশিপল্লির নামটা হবে বেশি। তাতে বাইরের বায়াররা আসবেন। আমরা যদি বড় বড় অর্ডার পাই, তাহলে আমাদের কর্মী যারা আছে, তাদের অনেক কাজ বাড়বে। নকশিপল্লি হলে সবার জন্যই সুবিধা হবে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় আমরা পাইকারিভাবে পণ্য দিচ্ছি। তারা একটা জায়গায় আসবে বিভিন্ন পণ্য নেবে।

জীবিকা হস্তশিল্পের স্বত্বাধিকারী হালিমা দেওয়ান ঝিনুক বলেন, জামালপুরের শেখ হাসিনা নকশিপল্লি আমাদের অর্জন, আমাদের গর্ব। এখানে এমন একটা পল্লি হতে যাচ্ছে। এটা হলে আমাদের সুবিধা হবে জামালপুরে যারা ব্যবসায়ী মালিক আছে, ব্যবসায়ী সংগঠন আছে, সবাই একসঙ্গে থাকব। সবার একটা দোকানের ব্যবস্থা হবে। সেই সঙ্গে ক্রেতা ও বিক্রেতার সুসম্পর্ক তৈরি হবে।

বাইরে থেকে যে ক্রেতারা আসবে, তারা এক জায়গা থেকে সব প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারবে। নারী কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকলে আরও ভালো হবে। অনেক কিছু জানতে পারবে, শিখতে পারবে, বুঝতে পারবে। সে ক্ষেত্রে আমারা একটা সফলতা অর্জন করতে পারব। সেখানে যদি কাঁচামালের একটা ব্যবস্থা রাখা হয়, আমাদের জন্য ভালো হবে। সবকিছু ঠিক থাকলে আমরা নকশিপল্লিকে সুন্দরভাবে গুছিয়ে তুলতে পারব।

দি চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক ইকরামুল হক নবীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের জামালপুর জেলা হস্তশিল্পে সমাদৃত। যে কারণে জামালপুরে শেখ হাসিনা নকশিপল্লি গড়ে উঠেছে। এই নকশিকাঁথা বাংলাদেশ ছাড়িয়ে পৃথিবীর বুকেও ছাপ রেখেছে। জামালপুরের যে ব্যান্ডিং হয়েছে, তা এই নকশিকাঁথার জন্য। যার প্রতিপাদ্য হলো জামালপুরের নকশিকাঁথা বাংলাদেশের গর্বগাথা। এরই ধারাবাহিকতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের শেখ হাসিনা নকশিপল্লি দিয়েছেন। যেখানে ব্যাপক উন্নয়ন হবে এবং এর মাধ্যমে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটবে। এই শিল্পে ইতিমধ্যে দি চেম্বার অব কমার্সের উদ্যোগে আমরা গর্ভনর আতিউর রহমানের সময় একটি আলাদা স্কিম করে যখন ব্যাংকে রেট অব ইন্টারেস্ট ছিল ১৪ থেকে ১৩ শতাংশ, সে সময় শুধু নারীদের ৯ শতাংশ হারে ঋণের সুবিধা দিয়ে এই শিল্পটিকে বিকাশের সুযোগ করে দিয়েছি।

তিনি আরও বলেন, এই শিল্প আমাদের দেশের যে অর্ধেক নারী, তাদের আর পিছিয়ে রাখবে না। কারণ আমাদের নারীরা ঘরে বসেই এ কাজ করতে পারবেন। একজন নারীর একটি কাঁথা যখন বিক্র‍য় উপযোগী হয়, ৬-৭ হাজার টাকা দাম হয়। উন্নত মানেরগুলো ১০-১২ হাজার টাকা দাম হয়। ফলে একটি নারী ঘরে বসে থেকেই উপার্জনের একটি মাধ্যম খুঁজে পেলেন। তারা পিস, সোফার কোশন, টিস্যু বক্স ইত্যাদি তৈরি করছেন। এভাবেই এর বিকাশ ঘটছে। পলিথিন আমাদের যে ক্ষতি করে, এটি পরিবেশবান্ধব। এই শিল্পের বিকাশের জন্য আরও অনেক কাজ করার প্রয়োজন আছে। আমি বিশ্বাস করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে আমাদের শেখ হাসিনা নকশিপল্লি আমাদের দিয়েছেন, তার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান হবে।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দলোনের (পবা) সভাপতি অ্যাডভোকেট ইউসুফ আলী জানান, জামালপুরে নকশিপল্লি স্থাপিত হলে হাজার হাজার নারী কর্মীর কর্মসংস্থান তৈরি হবে। কাজের গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে, নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে। শুধু জামালপুর নয়, সারা দেশের অনেক নারীই এই শিল্পের মাধ্যমে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে। এতে জামালপুরের সার্বিক আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন হবে, বিকশিত হবে নকশিশিল্প।

এনএ