দিবস পালিত হলেও ভাষাসৈনিকদের খোঁজ নেয় না কেউ
•কিশোরগঞ্জে আন্দোলনে সম্মুখসারিতে ছিলেন আব্দুল আজিজ
•আন্দোলনে অংশ নিতে বাধা ছিল না পরিবার থেকে
•ভাষাসৈনিকদের মর্যাদা আলাদা হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি
•সরকারের কাছে তার একটাই চাওয়া ভাষা আন্দোলনে অবদানের স্বীকৃতি
ঢাকায় ভাষার জন্য আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি গুলি চালানো হয়। ঘটনাস্থলেই নিহত হন একজন। ছাত্র হত্যার সেই খবর মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। জেলায় জেলায় আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন ছাত্র-শিক্ষক-জনতা। কিশোরগঞ্জেও আন্দোলনে নামে নানা শ্রেণিপেশার মানুষ। মিছিল-স্লোগানে মুখর সেই আন্দোলনে কলেজছাত্রদের মধ্যে সম্মুখসারিতে ছিলেন আব্দুল আজিজ। তখন তিনি কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা পোস্টকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে সেই সময়ের স্মৃতি রোমন্থন করে আব্দুল আজিজ বলেন, ‘২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের ওপর গুলি চালানো হলে ওইদিন বিকেলেই আন্দোলনের জন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা সংগঠিত হয়। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি গুরুদয়াল কলেজ থেকে প্রথম মিছিল নিয়ে বের হই। আমরা মিছিল নিয়ে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্যরাও এতে যোগ দেয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি আমাদের কাছে খবর আসে কিশোরগঞ্জের শহীদি মসজিদের ইমাম ও নেজামে ইসলামের সভাপতি মাওলানা আতাহার আলী বাংলা সমর্থন করেন না। এরপর আমরা কয়েকজন মিলে তার সঙ্গে দেখা করি এবং আমাদের ডাকা মিছিল ও সমাবেশে তিনি বাংলার পক্ষে বক্তব্য দিতে বাধ্য হন।’
বিজ্ঞাপন
এ আন্দোলনে অংশ নিতে বাধা ছিল না পরিবার থেকেও। কেননা সবার মনোভাবই তখন রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে ঘিরে। তিনি বলেন, ‘বাবা-মা কেউই আন্দোলনে যাওয়ার ব্যাপারে নিষেধ করেননি। বাড়ি ফেরার পরও এ ব্যাপারে তারা দ্বিমত করেননি। এলাকার মানুষ যখন জানতে পারেন আমি ভাষা আন্দোলনে গিয়েছি, তখন তাদের ব্যবহারও অন্যরকম ছিল। আলাদা এক ধরণের স্নেহ ছিল আমার জন্য।’
দীর্ঘ আলাপচারিতার একপর্যায়ে আব্দুল আজিজের কণ্ঠে ভেসে আসে আক্ষেপের সুর। ‘যে ভাষার জন্য এত আত্মত্যাগ, বিশ্বব্যাপী এত সম্মাননা, সেই ভাষার অবস্থান এখন কোথায়? দেশের জন্য কিংবা দেশের মানুষের জন্য সেই ভাষার ব্যবহার কতভাগ নিশ্চিত হয়েছে?’
এ ভাষা সৈনিকের ভাষ্য, ‘বাংলাদেশের সংবিধানে একটি ভাষার কথাই আছে, তা হলো বাংলা। কাগজে কলমে বাংলা ভাষার মর্যাদা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে বাংলার মর্যাদা ও কার্যকারিতার খুবই অভাব। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাতেও বাংলার প্রয়োজনীয়তা খুব একটা নেই। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা বাংলা নিয়ে পড়াশোনা করে তাদেরও সাধারণ মানুষ কটু চোখে দেখে। এমনকি শিক্ষক ও অভিভাবকদের কাছেও তারা সঠিক মর্যাদা পায় না।’
বাংলার প্রতি আকর্ষণ কম থাকার অন্যতম কারণ হিসেবে তিনি দায়ী করছেন সরকারি কার্যালয়গুলোতে বাংলা প্রতিষ্ঠিত না হওয়াকে। আব্দুল আজিজ বলেন, ‘ইংরেজি যারা ভালো জানে-পারে চাকরিতে তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এটা মেনে নেওয়া যায় না। এর সমাধান আসবে যদি বাংলাকে প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হয়।’
ভাষা আন্দোলনের ঊনসত্তর বছরেও সরকারিভাবে করা হয়নি ভাষাসৈনিকদের তালিকা। ভাষাসৈনিকরা রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতিও পাননি। এ নিয়েও বেশ আক্ষেপ রয়েছে ভাষার জন্য আন্দোলন করা এ বীর সেনানীর।
আব্দুল আজিজ তালুকদার বলেন, ‘ভাষার জন্য যারা সংগ্রাম করেছে তাদের মর্যাদা আলাদা হওয়া উচিত। কেননা দেশের জন্য সশস্ত্র যুদ্ধ করার মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে কিংবা প্রেরণা এই ভাষা আন্দোলন থেকেই।’
প্রতিবছর যথাযোগ্য মর্যাদায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে স্মরণ করা হয় ভাষার জন্য আত্মদান করা সেই বীর শহীদদের। তবে সেই সময়ে আন্দোলনকারীরা যারা এখনও বেঁচে আছেন, তাদের কখনও স্মরণ কিংবা কোনো অনুষ্ঠানে ডাকা হয় না। এ নিয়েও হতাশা রয়েছে এই ভাষাসৈনিকের। তিনি বলেন, ‘ঘটা করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হলেও আমাদের খোঁজ কেউ রাখে না। ১৯৮৩ সাল থেকে ময়মনসিংহে অবস্থান করছি। ২১ ফেব্রুয়ারি আসলে বেসরকারি দুএকটি সংগঠন ডেকে নিয়ে ভাষাসৈনিক হিসেবে সম্মানিত করে। কিন্তু রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনো খোঁজই নেওয়া হয় না কখনও। আমাদের তো কোনো দাবি নেই। শুধু একটাই চাওয়া সাধারণ মানুষ ইতিহাসটা অন্তত জানুক।’
নেত্রকোনার পূর্বধলায় ভাষাসৈনিক আব্দুল আজিজের পৈত্রিক নিবাস হলেও শিক্ষকতার সুবাদে ১৯৮৩ সালে তিনি চলে আসেন ময়মনসিংহ শহরে। এরপর থেকে পরিবার নিয়ে বসবাস করে আসছেন শহরের সানকিপাড়ার এসএ সরকার রোড এলাকায়।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনও রয়েছে এ ভাষাসৈনিকের। ১৯৫৩ সাল থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও ১৯৫৭ সালে যোগ দেন ন্যাপে। এরপর ১৯৬০ সালে ন্যাপ ছেড়ে জড়ান বাম রাজনীতিতে। ১৯৯৩ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির ময়মনসিংহ জেলা শাখার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। বর্তমানে শারীরিক দুর্বলতা আর বার্ধক্যে এই ভাষাসৈনিকের সময় কাটছে বই-পত্রিকা পড়ে আর টেলিভিশন দেখে। জীবনের শেষ সময়ে সরকারের কাছে তার একটাই চাওয়া ভাষা আন্দোলনে অবদানের স্বীকৃতি।
এসএসএইচ