‘তোমাদের পায়ে ধরি আমার উৎপলকে আইনা দাও। তাকে কোথাও দেখছি না কেন। এভাবে সে চলে যেতে পারে না। সবাই কয় ও আর আসবে না ,কিন্তু কেন আসবে না কও। ও আমার ছোট বেটা ও আমাকে ছেড়ে কোথাও যাইতে পারে না। ও কোথায় গেল কও।’

কথাগুলো বলতে বলতে অঝোরে কেঁদে চলেছেন নিহত শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারের মা গীতা রানী (৮৫)। তার আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠেছে এলাকার পরিবেশ। কাঁদছেন প্রতিবেশীরাও। বুধবার (২৯ জুন) দুপুরে উল্লাপাড়া উপজেলার লাহিড়ী মোহনপুর ইউনিয়নের এলংজানী গ্রামের নিহত শিক্ষকের বাড়িতে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা যায়। 

বাড়িতে ঢুকেই দেখা যায়, শোকের মাতম চলছে উৎপলের পরিবারে। ভারী হয়ে গেছে পরিবেশ। উৎপলের মা গীতা রানী নির্বাক হয়ে পড়েছেন। মাঝে মাঝে অস্পষ্ট কণ্ঠে শুধু বলছেন, ‘তোমরা আমার উৎপলরে আইনা দাও, এইভাবে সে চইলা যাইতে পারে না।’ সন্তানের মরদেহ দেখার পর থেকে কাঁদতে কাঁদতে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন এই মা। অকালে সন্তান হারানোর শোক যেন কোনোভাবেই সইতে পারছে না। শুধু মা গীতা রানী নন, এমন করুণ অবস্থা এখন ওই পরিবারের সবারই। 

উৎপল কুমার সরকার পরিবারের আট ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট হলেও তিনিই পরিবারের সব কিছু দেখাশোনা করতেন বলে জানান তার দাদা অসীম কুমার সরকার ও অসিত কুমার সরকার।

শুধু উৎপলের মা নন, একই অবস্থা উৎপলের স্ত্রী বিউটি রানী নন্দী, উৎপলের শাশুড়ি ছবি রানী নন্দীসহ সবার। 

মাত্র ৩৩ বছর বয়সে স্বামী হারানোর শোক মেনেই নিতে পারছেন না উৎপলের স্ত্রী বিউটি। ভাষা হারিয়ে যেন নিশ্চুপ হয়ে পড়েছেন তিনি। মেনেই নিতে পারছেন না স্বামী আর এ পৃথিবীতে নেই। বলছেন সকালেও হাসিমুখে বের হয়েছেন উৎপল। জানা মতে তার কোনো শত্রুও ছিল না, বরং ভালো শিক্ষক হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

উৎপলের স্ত্রী বিউটি রানী নন্দী ঢাকা পোস্টকে বলেন, সকালে উৎপল বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছে এবং দুপুরে এ ঘটনা। তারপরও কলেজ কর্তৃপক্ষ আমাকে বিষয়টা জানায়নি। কিন্তু তাদের এটা জানানো উচিত ছিল। পরবর্তীতে বিকেলে আমার জা (উৎপলের দাদার স্ত্রী) আমাকে জানায় যে এ রকম একটা ঘটনা ঘটেছে। পরে আমি জানার পরে সন্ধ্যায় সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখি সে আইসিওতে ভর্তি আছে এবং মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। পরবর্তীতে সোমবার সকালে সে আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেল।

বিউটি আরও বলেন, উৎপলকে ছাড়া আমি খুব অসহায় হয়ে পড়েছি, তাকে ছাড়া আমার এখন পথ চলাটাই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আমি কী করব, কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। মাত্র তিন বছর হলো আমাদের বিয়ে হয়েছে, এখনো আমাদের কোনো সন্তান হয়নি।

তিনি বলেন, উৎপলকে ছাড়া আমার জীবনটা একদম শূন্য। এই যে বাড়িতে এসেছি, সবার সঙ্গে কথা বলছি, সবাই আমাকে জিজ্ঞাসা করছে। কিন্তু আমি কাউকে কিছুই বুঝাতে পারছি না। তার শূন্যতা আমি কীভাবে বুঝাব এটাও বুঝতে পারছি না। আমি মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার স্বামী হত্যার সঠিক বিচার চাই। আমার স্বামীকে ষড়যন্ত্র করে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে এটা আমি বুঝতে পেরেছি। 

উৎপলের মেজো দাদা অসীম কুমার সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি এবং আমার আরেক ভাই ওই এলাকাতেই থাকি। আমাদের ওখানে নিয়ে গিয়ে একটি টেইলার্সের দোকান করে দিয়েছে উৎপল। ঘটনার দিন আমি দুপুর ১টার দিকে ওই স্কুলের পাশ দিয়েই বাসায় যাই। তখন স্কুলে মেয়েদের ক্রিকেট খেলা চলছিল। আমার বাড়িওয়ালার ছেলেমেয়েকে উৎপল প্রাইভেট পড়াত। সেই হিসেবে আমি বাড়িতে যাওয়ার পরে তারা আমাকে বলে, উৎপল স্যারকে তো মারা হয়েছে। আমি শোনামাত্রই তার স্কুলে যাই। গিয়ে দেখি স্কুল বন্ধ, কেউ নাই।

পরবর্তীতে আমি উৎপলের মোবাইলে বেশ কয়েকবার ফোন দেওয়ার পরে অন্য একজন শিক্ষক ফোন ধরে আমাকে আশুলিয়া মা ও শিশু হাসপাতালে যেতে বলেন। তখন দুপুর ২টা বাজে। আমি সেখানে পৌঁছে দেখি উৎপলকে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। তখন আমিও সেই অ্যাম্বুলেন্সে উঠে পড়ি। তারপর থেকে সেখানে ভর্তি থাকাবস্থাতেই সোমবার ভোর ৫টা বা সাড়ে ৫টার দিকে চিকিৎসক উৎপলকে মৃত ঘোষণা করেন।

তিনি বলেন, উৎপল ছাড়া আমরা একদম অসহায়। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে উৎপল হত্যার বিচার চাই। 

উৎপলের আরেক দাদা অসিত কুমার সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে উৎপলের মরদেহ নেওয়া হয় ময়নাতদন্তের জন্য। তারপরে ময়নাতদন্ত শেষ করে অ্যাম্বুলেন্সে করে তার মরদেহ বাড়িতে নিয়ে আসা হয় রাত ১০টার দিকে। প্রায় দেড় ঘণ্টা বাড়িতে অবস্থান করার পরে রাত সাড়ে ১১টার দিকে পার্শ্ববর্তী মোহনপুর মহাশ্মশানে নেওয়া হয় শেষকৃত্য সম্পন্ন করার জন্য। সেখানে রাত ৩টা সাড়ে ৩টার দিকে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।  

তিনি আরও বলেন, তাকে ছাড়া আমরা খুব অসহায় হয়ে পড়েছি, সে আমাদের আট ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট। আমরা কখনো কল্পনা করিনি উৎপল আমাদেরকে ছেড়ে এভাবে কখনো চলে যাবে। তাকে হত্যার বিষয়টি আমরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে হত্যাকারীর ফাঁসির দাবি জানাই। 

উৎপলদের পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তার দাদা অজয় সরকারের একমাত্র ছেলে অভি সরকার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে গণিত বিভাগে। বংশের একমাত্র পুত্র সন্তান হওয়ার সুবাদে তার কাকার মৃত্যুর পরে সকল ধর্মীয় রীতি-নীতি তাকেই পালন করতে হচ্ছে। কাকার শেষ বিদায়ে চিতায় মুখাগ্নিও করেছেন তিনি।

অভি ঢাকা পোস্টকে বলেন, কাকার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল অনেকটা বন্ধুর মতো। তাকে আমি তুই বলে সম্বোধন করতাম। তার প্রেরণাতেই আজ আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছি। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগেও ঢাকাতে তার কাছে থেকে পড়াশোনা করেছি। তাকে হত্যা করা হয়েছে তাও আবার তারই ছাত্র দ্বারা। এ কথাটা আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না। একজন ছাত্র যখন একজন শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা করে, সেটা যে কত বড় কলঙ্কের এটা বলে বোঝানো যাবে না। হত্যাকারী জিতু শুধু একজন শিক্ষককে হত্যা করেনি সে সমগ্র ছাত্রসমাজকে কলঙ্কিত করেছে। 

অন্যদিকে উৎপলের মৃত্যুতে কেঁদে চলেছেন প্রতিবেশীরাও। এলাকাবাসী জানান, উৎপল খুবই ভালো ছেলে ছিলেন। উৎপলের পরিবারে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। নির্বাক হয়ে পড়েছেন উৎপলের মা। পরিবার ও এলাকাবাসীরও একই কথা। এভাবে মরতে পারেন না উৎপল। তাকে হারিয়ে যেন বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছে তার পরিবার। উৎপল নেই, পরিবারের সঙ্গে তারাও এটা বিশ্বাস করতে পারছেন না।

প্রতিবেশী বাবলু হোসেনসহ কয়েকজন ঢাকা পোস্টকে বলেন, উৎপল ছিল এই পরিবারের সর্বোচ্চ শিক্ষিত ছেলে। সবার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আয় করা মানুষ। সে নিজের পরিবার চালানোর পাশাপাশি তার মা-দাদাসহ সবাইকেই দেখাশোনা করতেন। সেই মানুষটির মৃত্যুতে এ পরিবারটি আজ অসহায় হয়ে পড়ছে।

মোহনপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আবুল কালাম আজাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, উৎপল খুব ভালো একজন ছেলে ছিল, এটা শুধু আমি নই ইউনিয়নের সবাই এক বাক্যে বলবে। কোনো শিক্ষক অপরাধ করলেও তার প্রচলিত আইনে শাস্তি হতে পারে কিন্তু কোনো ছাত্র বখাটে হয়ে যাচ্ছে, ইভটিজিং করছে, মাদক নিচ্ছে আর তাকে শাসন করলে যদি শিক্ষককে মরতে হয়, তাহলে কোনো শিক্ষক আর কাউকে শাসন করবে না। ফলে যুবসমাজ তখন নষ্ট হয়ে যাবে। আমি উৎপলের হত্যাকারীকে খুঁজে বের করে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। 

উল্লেখ্য, উৎপল উল্লাপাড়া উপজেলার মোহনপুর ইউনিয়নের এলংজানী গ্রামের মৃত অজিত সরকারের ছেলে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেন তিনি। আশুলিয়ার চিত্রশাইল এলাকার হাজী ইউনুস আলী স্কুল  অ্যান্ড কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক হিসেবে ১০ বছর কর্মরত ছিলেন। উৎপল ওই প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় উচ্ছৃঙ্খল শিক্ষার্থীদের মানসিক উন্নয়নে কাজ ও শাসন করতে হয়েছে তাকে।

গত শনিবার (২৫ জুন) হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে ছাত্রীদের ফুটবল খেলা চলছিল। প্রভাষক উৎপল মাঠের এক পাশে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছিলেন। এ সময় ওই প্রতিষ্ঠানের দশম শ্রেণির ছাত্র আশরাফুল ইসলাম জিতু ক্রিকেটের স্টাম্প নিয়ে এসে উৎপলকে বেধড়ক পেটাতে শুরু করেন। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে আইসিউতে রাখা হয়। দুইদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে সোমবার সকালে তিনি মারা যান। 

আরএআর