রাত পেরোলেই পবিত্র ঈদুল আজহা। আগামীকাল পশু কোরবানির মাধ্যমে উদযাপিত হতে যাচ্ছে মুসলমানদের বড় উৎসব কোরবানির ঈদ। আর এই ঈদ উপলক্ষে পরিবারের সবার জন্য করা হয়েছে কেনাকাটা। আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে সব কর্মব্যস্ততা শেষ করে প্রিয়জনদের কাছে ছুটে যাচ্ছে দূরবর্তী সদস্যরা।

তবে যাদের পরিবার বা প্রিয়জন নেই, তারা কীভাবে ঈদ উদযাপন করে? কী তাদের প্রস্তুতি? তাদের কাছেও ঈদুল আজহা কি উৎসবের আমেজে মোড়ানো নাকি এই দিনে নিঃসঙ্গ জীবনে প্রিয় কেউ না থাকার একসাগর দুঃখ আর হতাশা?

তেমনই কয়েকজন আল্লাহর মেহমান আছেন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের মাহাপুর লিল্লাহ বোডিং মাদরাসা ও এতিমখানায়। যাদের কাছে দুটি ঈদ আর দশ দিনের মতোই স্বাভাবিক। হয়তো এ দুটি ঈদের দিনে অস্বাভাবিকতা লুকিয়ে রাখে চোখের কোণে।

জনি ইসলাম (১৪)। এতিমখানার হেফজ বিভাগে পড়ছে। কোনো আত্মীয়স্বজন না থাকায় এবার কোরবানি ঈদ মাদরাসায় করবে সে। কেউ মাংস পাঠালে এতিমখানায় তা রান্না করে খেয়ে তৃপ্ত হবে তারা।

একদিন তারও ছিল সবকিছু। দুই ভাই ও মা-বাবাসহ ভালোই চলছিল তাদের সংসার। তার বাবা ছিলেন দিনমজুর, মা গৃহিণী। পাঁচ বছর আগে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান তার বাবা। পরিবারে নেমে আসে অন্ধকার। দুই ছেলেসন্তানকে নিয়ে দিগবিদিক ছোটেন তার মা। এর দুই বছর পর তার মাও তাদের ছেড়ে চলে যান না-ফেরার দেশে। এতিম হয় জনি ও তার ভাই।

কিছুদিন পরে তার এক খালার মাধ্যমে ভর্তি হয় মাহাপুর লিল্লাহ বোডিং মাদরাসা ও এতিমখানায়। সেদিন থেকে জনির সুখ-দুঃখের পৃথিবী মাদরাসা চার দেয়ালের ভেতরে।

শুধু জনি নয়, তার সঙ্গে ঈদ করবে মা-বাবা হারানো একই মাদরাসার সুমন, কাওসার ও আশরাফুল। ঈদের নামাজ শেষ করে তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মাংস তুলে মাংস-রুটি খাবে। তবে হাজারো কষ্টের পরও তারা এখনো স্বপ্ন দেখে, কোনো একদিন পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করবে তারা।

জনি হাসান বলে, আমার মা-বাবা মারা যাওয়ার পর আমাদের দুই ভাইয়ের অনেক কষ্ট হয়। এক বেলা খেতাম, এক বেলা খেতাম না। বাধ্য হয়ে আমাকে এক খালা মাদরাসায় ভর্তি করে দেন। আমার ভাইকে সাইকেল মেকানিকের দোকানে দিয়ে দেন। এখন আমার সব খরচ মাদরাসা বহন করে।

কষ্ট অনুভব করে জনি বলে, ঈদের আগে আমার বাকি ছাত্র ভাইদের মা-বাবারা তাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তাদের বাড়িতে নিয়ে যান। তখন খুব কষ্ট লাগে। আমার তো মা-বাবা নেই। আমাদের কে নিয়ে যাবে? আমার মতো আরও তিনজন ভাই আছে। ঈদের দিন আমরা একসঙ্গে কাটাই। খালা আসার কথা ছিল কিন্তু আসেননি।

আরেক ছাত্র কাওসার বলে, আমি আমার বাবা-মায়ের কথা বলতে পারব না। উনাদের আমি দেখিনি। ছোটবেলা নানা-নানির কাছে ছিলাম। এখন মাদরাসায় থাকি। সবাই ঈদে বাবা-মায়ের কাছে যায়। আমার সেই কপাল নেই। আমি কোনো সময় নানির কাছে যায় ঈদে, না হলে মাদরাসায় ঈদ করি। এবারে ঈদ মাদরাসায় করব।

সুমন ইসলাম বলে, আমি কয়েক বছর থেকে মাদরাসায় ঈদ করি। আমরা নামাজ পড়ে এসে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মাংস তুলি। কেউ কারও বাড়িতে খাওয়ালে খাই। মাংস তুলে নিয়ে আসার পর আমরা মাদরাসায় যে কয়েকজন আছি, রান্না করে খাই। এভাবেই আমাদের ঈদের দিন কেটে যায়। আমাদের এর চেয়ে আলাদাভাবে ঈদের আনন্দ করার সুযোগ কই? ভাগ্য এটাই আমাদের। আমাদের ছাত্র ভাইয়েরা তাদের পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে গেছে। আমাদের ঈদে বাড়ি যাওয়া হয় না। আর পরিবারের সঙ্গে কখনো ঈদ করাও হয় না।

মাহাপুর লিল্লাহ বোডিং মাদরাসা ও এতিমখানার পরিচালক মাওলানা খয়রুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের মাদরাসায় ৮০ জন ছাত্র আছে। তাদের মধ্যে ১২ জন এতিম। তাদের কাছে কোনো বেতন নেওয়া হয় না। তাদের ফ্রি খাওয়ানো ও পড়াশোনা করানো হয়। আমরা সবার সহযোগিতা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি চালাই। কয়েক এতিম বাচ্চাকে তাদের আত্মীয়স্বজনরা নিয়ে গেছেন তাদের সঙ্গে ঈদ করার জন্য। চারজন এখানেই ঈদ করবে। তারা ঈদের দিন মাংস তুলে এনে তারপর খাবে।

আমাদের প্রতিষ্ঠানের সামর্থ্য নেই প্রতিষ্ঠানে কোরবানি করার। কারণ, এমনি প্রতিষ্ঠান চালাতে হিমশিম খেতে হয়। তবে কেউ যদি এই এতিম বাচ্চাদের সহযোগিতা করে বা ঈদে তাদের আনন্দের স্বার্থে এখানে কোরবানি করে, তাহলে তারা খুশি হবে ইনশা আল্লাহ। আমি অনুরোধ করব, আপনারা আমাদের এ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও এতিম বাচ্চাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবেন। 

এনএ