উঠে দাঁড়াতে পারেন না। হুইলচেয়ারে বসেই পার করছেন সময়। জন্ম থেকে প্রতিবন্ধী হলেও প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও মনোবলের কাছে হেরে গেছে সকল বাধা। হুইল চেয়ারে বসেই স্নাতকোত্তর পাস করেছেন তিনি। এখন একটি সরকারি চাকরির আশা করছেন। তবে সেওতির ভবিষ্যত নিয়ে তার মায়ের কান্না যেন থামছেই না। 

পুরো নাম শাহিনা সুলতানা সেওতি। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ঘোনা ইউনিয়নের ঘোনা গ্রামের দিনমজুর আব্দুর রকিবের মেয়ে। তিন ভাই বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। আব্দুর রকিব ও জাহানারা বেগম দম্পতির ঘরে ১৯৯৪ সালের ২৫ জুলাই প্রথম সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তবে জন্ম থেকেই সেওতি প্রতিবন্ধী।

প্রতিবন্ধী হওয়ায় বাবা-মা লেখাপড়া করাতে প্রথমদিকে অনীহা প্রকাশ করেন। তবে সেওতির প্রবল ইচ্ছাশক্তির কাছে হেরে যায় বাবা-মায়ের অনীহা। ভর্তি হন স্কুলে। এরপর হুইল চেয়ারে করেই ঘোনা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে যায় মেয়েটি। মানবিক বিভাগে ২০০৯ সালে এসএসসিতে জিপিএ ৩.৯০ পয়েন্ট নিয়ে ভর্তি হয় সীমান্ত আদর্শ ডিগ্রি কলেজে। সেখানেও সফলতার স্বাক্ষর রাখে নিয়মিত।

২০১১ সালে ৩.৯০ পয়েন্ট নিয়ে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। ছাড়িয়ে যায় উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি। নানা প্রতিকূলতাকে হারিয়ে সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে ইতিহাস বিভাগে অনার্সের জন্য শুরু হয় সেওতির নতুন যুদ্ধ। অবশেষে ২০১৬ সালে দ্বিতীয় বিভাগে অনার্স শেষ হয় তার। এরপর একই কলেজ থেকে ২০১৮ সালে শেষ করেন মাস্টার্স। ইতিহাস বিষয়ে প্রথম বিভাগে সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে লেখাপড়ার জীবন শেষ করেন। 

সেওতিকে দেওয়া ঘরের নির্মাণ কাজ পরিদর্শনে প্রশাসনের কর্মকর্তারা

জীবনযুদ্ধে সংগ্রামী শাহিনা সুলতানা সেওতির জীবনের গল্পটা অনেক কষ্টের। গল্পটি জানাতে গিয়ে আপ্লুত হয়ে পড়েন মা জাহানারা বেগম। তিনি বলেন, প্রথম সন্তান হওয়ার পর খুব খুশি হয়েছিলাম। তবে যখন জানতে পারলাম মেয়েটি প্রতিবন্ধী ও চলাফেরা করতে পারবে না কখনও তখন খুব কষ্ট পেলাম। 

তারপরও মেয়েকে অবহেলা করিনি কখনও। কষ্টে বড় করেছি। ওর চলাফেরা করতে দুইজনের প্রয়োজন হয়। হুইলচেয়ার থেকে উঠতে পারে না। এখনকার ছেলেদের তো বোঝেন কার হাতে তুলে দিব, কে নিবে দায়িত্ব? ভবিষ্যতে কী হবে মেয়ের এই ভেবে চিন্তার শেষ নেই। 

জাহানারা বেগম বলেন, প্রথমে আমরা ওকে স্কুলে ভর্তি করতে চাইনি। তবে সেওতির আগ্রহ দেখে ভর্তি করে দেই। মনে করেছিলাম, যা মন চাই করুক। একে একে স্কুল, মাধ্যমিক, কলেজ সব শেষ করে ফেলেছে। আমাদের এখন বয়স হয়েছে। দুই ছেলেকে নিয়ে চিন্তা নেই। তবে সেওতিকে নিয়ে খুব চিন্তা হয়। যখন থাকব না তখন ওকে কে দেখবে? মাস্টার্স পাস করেছে, একটা সরকারি চাকরি পেলে আমাদের আর কষ্ট থাকবে না। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে সেওতির জন্য একটি চাকরি চাই।

বাবা আব্দুর রকিব বলেন, আমি দিনমজুর মানুষ। আল্লাহ ওকে এই পর্যন্ত এনেছে। আমি চেষ্টা করেছি। কখনও কারো কোনো সহযোগিতা আমি পাইনি। বয়স বেড়েছে এখন আর পারি না।

সংগ্রামী শাহিনা সুলতানা সেওতি বলেন, অনেক প্রতিকূলতার মধ্যদিয়ে আমি আজ পর্যন্ত টিকে আছি। অন্য সবার থেকে আমার জীবনটা ভিন্ন। আমি একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। সবাই অবজ্ঞা অবহেলা করেছে, তবে আমার নিজস্ব শক্তি দিয়ে টিকে আছি। ডিসি স্যার আমাকে একটা ঘর দেবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলার চেষ্টা করবেন। আমার ভালো হুইলচেয়ার নেই, সেটাও তিনি দিতে চেয়েছেন।

সেওতি বলেন, জীবনযুদ্ধে যেন আমি জয়ী হতে পারি। সেজন্য আপনাদের সহযোগিতা প্রয়োজন। আপনাদের ভালোবাসা ও দোয়া নিয়েই আমি সামনের পথ অতিক্রম করতে চাই।

ঘোনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন বলেন, মেয়েটি খুব প্রতিভাবান। প্রতিবন্ধী হলেও লেখাপড়া শেষ করেছে। এলাকার সকলেই তাকে চেনে জানে। খুবই ভালো মেয়ে। মেয়েটি ও তার পরিবারের দাবি একটি চাকরির। সেটি হলে পরিবারটিতে আর বোঝা হয়ে থাকতে হবে না মেয়েটিকে। 

সেওতি একজন অদম্য তরুণী। ঘটনাটি জানার পর বিস্তারিত খোঁজ খবর নিয়েছি। জেনেছি তাদের থাকার ঘরটি ভালো নয়। জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের অ্যাডমিন ক্যাডারের অফিসাররা মিলে দুই লাখ টাকার একটি ঘর নির্মাণ কাজ শুরু করেছি। 

এস এম মোস্তফা কামাল, জেলা প্রশাসক, সাতক্ষীরা

এছাড়া তাকে আত্মনির্ভরশীল করতে একটি ল্যাপটপ দেওয়া হবে এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। সেওতির ভালো একটি হুইল চেয়ার নেই। যে কেউ চাইলে এটাও দিতে পারবেন। অদম্য সেওতিকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হবে।

এসপি