শেরপুরের নালিতাবাড়ীর ঐতিহাসিক সোহাগপুর বিধবাপল্লির বিধবারা তাদের প্রতিষ্ঠিত সোহাগপুর বীর কন্যা প্রাথমিক বিদ্যালয়টি সরকারি করার দাবি করেছেন। সোমবার (২৫ জুলাই) নালিতাবাড়ীর সোহাগপুর গণহত্যা দিবসে এ দাবি করেন বিধবা ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা।

২০১৫ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সোহাগপুর বীর কন্যা প্রাথমিক বিদ্যালয়। এ বিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ছয়জন শিক্ষককে। কিন্তু সরকারি কোনো সুবিধা না পাওয়ায় বিনা বেতনে লেখাপড়া চালু রাখা হয়েছে এ বিদ্যালয়ে।

১৯৭১ সালের এই দিনে সোহাগপুরে পাক হানাদার বাহিনী হামলা চালিয়ে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদররা এদিন মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যে গ্রামের ১৮৭ জন পুরুষকে হত্যা করে। পুরুষশূন্য হয়ে পড়ে উপজেলার কাঁকরকান্দি ইউনিয়নের সোহাগপুর গ্রাম। এরপর থেকেই গ্রামটির নাম হয় সোহাগপুর বিধবাপল্লি।

জানা যায়, বৃহত্তর ময়মনসিংহের তৎকালীন আলবদর কমান্ডার জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের প্রত্যক্ষ মদদে ও স্থানীয় রাজাকার কাদের ডাক্তারের সহায়তায় ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই নালিতাবাড়ী উপজেলার কাকরকান্দি ইউনিয়নের নিভৃতপল্লি সোহাগপুর গ্রামে ঘটে এক ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি।

সেদিন ওই গ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় নিয়েছে, এমন সংবাদের ভিত্তিতে রাজাকার আলবদরদের সহায়তায় ১৫০ জনের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্থানীয় প্রফুল্লের দিঘি থেকে সাধুর আশ্রম পর্যন্ত এলাকা ঘিরে ফেলে। হায়েনার দল অর্ধ দিনব্যাপী তাণ্ডব চালিয়ে খুঁজতে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের ও তাদের আশ্রয়দাতাদের। ওই সময় প্রাণের মায়া ত্যাগ করে সামনের দিকে এগিয়ে যান স্থানীয় কৃষক আলী হোসেন ও জমির আলী। কিন্তু তারা বেশি দূর যে‌তে পারেননি। এক রাজাকার গুলি করে দুজনকেই হত্যা করে। এরপর শুরু হয় আরও নারকীয় তাণ্ডব।

এ সময় মাঠে কর্মরত রমেন রিছিল, চটপাথাং ও সিরিল গাব্রিয়েল নামে তিন গারো আদিবাসীকে হত্যা করে। এরপর একে একে হত্যা করে আনসার আলী, লতিফ মিয়া, ছফর উদ্দিন, শহর আলী, হযরত আলী, রিয়াজ আহমেদসহ প্রায় ১৮৭ জন নিরীহ মানুষকে।

একই সময় পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন ১৩ জন নারী। সেদিন কলাপাতা, ছেঁড়া শাড়ি আর মশারি দিয়ে কাফন পরিয়ে এক কবরে চার থেকে পাঁচটি মরদেহ দাফন করা হয়েছিল। আবার কোনো কোনো কবরে সাত-আটটি করে মরদেহ দাফন হয়েছিল।

স্বাধীনতাযুদ্ধে সবাইকে হারালেও দীর্ঘদিন অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটে বিধবা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের। কেউ খোঁজ নেয়নি তাদের। বাড়ায়নি সহযোগিতার হাত। ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সাবেক মন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী ওই এলাকার সংসদ সদস্য হয়ে সর্বপ্রথম সোহাগপুরের বিধবাদের জনসমক্ষে আনেন। বাড়িয়ে দেন সহায়তার হাত। পরে আস্তে আস্তে অনেকেই এগিয়ে আসেন তাদের সহায়তায়।

বিধবাদের প্রত্যেকে ট্রাস্ট ব্যাংক থেকে ২ হাজার টাকা, বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক থেকে ৪০০ ও সরকার থেকে ৪০০ টাকা হারে বয়স্ক ভাতাসহ মোট ২ হাজার ৮০০ টাকা পাচ্ছিলেন। এরই মধ্যে ২৯ বিধবাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১১ লাখ টাকা দামের একটি করে পাকা বাড়ি উপহার দিয়েছেন। ১৪ জন বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বিধবাপল্লিতে পাকা সড়ক হয়েছে।

সেই বিধবাদের মূল্যায়নের পাশাপাশি তাদের পরিবার-পরিজনের দিন পরিবর্তনে কাজ করছে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন। নানা উৎসব-পার্বণে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন শরিক হয় তাদের সঙ্গে। এ ছাড়া দীর্ঘ ৫০ বছর পর শহীদদের স্মৃতি রক্ষার জন্য জেলা পুলিশ বিভাগের সদস্যরা তাদের বেতনের টাকা দিয়ে জমি কিনে দিয়েছেন। সেখানে জেলা প্রশাসনের আর্থিক সহায়তায় নির্মিত হয়েছে ‘সৌরজায়া’ নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ।

জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার নুরুল ইসলাম হিরু ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুই দফায় সোহাগপুর বীর কন্যা পল্লির ১৪ জন বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়ার পরও আরও কয়েকজন অপেক্ষমাণ রয়েছেন। তাদেরও একই আওতায় আনা প্রয়োজন।

পল্লির বিধবা হাফিজা বেওয়া বলেন, সরকার আমাগো অনেক কিছু দিছে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর প্রতি খুব খুশি। এহন আমরা চাই প্রাইমারি স্কুলডা সরকারি করা হোক।

বিধবা মহিরন বেওয়া বলেন, আমরা তো মইরাই জামুগা। আমাগো কথা কেডা কব? স্কলডা সরকারি করলে ওইহানে আমাগো নিয়া আলোচনা অইব। তাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি তিনি যেন আমাগো স্কুলডা সরকারি কইরা দেন।

নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান জানান, দিনটিকে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের লক্ষ্যে প্রতিবছরের মতো এবারও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণ, মিলাদ ও স্মরণসভার আয়োজন করা হয়েছে। আমরা বিদ্য্যালয়টিকে সরকারি করার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখব।

এনএ