নৌকায় বদলে গেছে রাণীদিয়ার ভাগ্য
সরাইল উপজেলার অরুয়াইল ইউনিয়নের রাণীদিয়া গ্রামের মানুষের ভাগ্য বদলে গেছে ভাড়ায় নৌকার ব্যবসায়
তিন দশক আগেও কৃষিকাজ ছিল রাণীদিয়া গ্রামের বাসিন্দাদের জীবিকার একমাত্র উৎস। খেয়ে না খেয়ে কোনো রকম দিন কেটেছে চেত্রা নদীর দক্ষিণ পাড়ের এই গ্রামের মানুষদের। কিন্তু এখন দিন বদলেছে। চরম অর্থকষ্টে দিন কাটানো রাণীদিয়ার মানুষ এখন মাসে আয় করছেন কয়েক কোটি টাকা।
ছায়া সুনিবিড় রাণীদিয়া গ্রামের আমূল পাল্টে দিয়েছে নৌকা ভাড়ার ব্যবসা। অর্থনৈতিক দৈন্যদশায় কাটিয়ে সমাজে আলাদা মর্যাদা পেয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার অরুয়াইল ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম রাণীদিয়া। গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতেই এখন দালানকোঠা রয়েছে।
বিজ্ঞাপন
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিতাসের শাখা নদী চেত্রার দক্ষিণপাড়ে রাণীদিয়া গ্রামের অবস্থান। রাণীদিয়া গ্রামটিতে প্রায় ১০ হাজার মানুষ বসবাস করেন। ভৌগোলিক কারণেও অনেকটা পিছিয়ে ছিল রাণীদিয়া। গ্রামের মানুষের জীবন ও জীবিকা ছিল কৃষিকাজ। যদিও তুলনামূলকভাবে সচ্ছল পরিবারের কেউ কেউ অরুয়াইল বাজারে বিভিন্ন পণ্যের ব্যবসা করতেন।
কিন্তু নব্বই দশক থেকে দিন বদলাতে শুরু করে রাণীদিয়ার মানুষদের। গ্রামের কয়েকজন কাঠের বডির নৌকা তৈরি করে ভাড়ায় পণ্য পরিবহনের কাজ শুরু করেন। বর্তমানে অরুয়াইল ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের ৪০০টি নৌকা ভাড়ায় খাটছে। এর মধ্যে রাণীদিয়া গ্রামের রয়েছে ৩০০টি নৌকা।
বিজ্ঞাপন
প্রতিটি নৌকা থেকে মাসে অন্তত দেড় লাখ টাকা আয় হয়। সে হিসেবে নৌকা ভাড়ার এই ব্যবসা থেকে শুধুমাত্র রাণীদিয়া গ্রামের মাসিক আয় সাড়ে ৪ কোটি টাকা। আর অন্যান্য গ্রামের ১০০টি নৌকা থেকে আরও দেড় কোটি টাকা আয় হয়। নৌকাগুলো ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নৌপথে পণ্য পরিবহন করে থাকে।
স্থানীয় নৌযান মালিক সমিতির দেওয়া তথ্য মতে, ১৯৯১ সালে প্রথম রাণীদিয়া গ্রামের মানুষজন নৌকা বানিয়ে পণ্য পরিবহন শুরু করেন। লাভজনক হয়ে উঠায় গ্রামের অধিকাংশ মানুষ এখন নৌকা ভাড়ার ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। প্রথম প্রথম গ্রামের কয়েকটি পরিবার কাঠের বডির নৌকা বানিয়ে ভাড়ায় পরিচালনা করলেও এখন স্টিল বডির নৌকা তৈরি করছেন স্থানীয়রা।
একেকটি নৌকা তৈরিতে খরচ হয় ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত। অরুয়াইল বাজার সংলগ্ন তিতাস ও চেত্রা নদীর দুই পাড়েই নৌকাগুলো বানানো হয়। ছোট নৌকাগুলো বানাতে সময় লাগে ৩ মাস, আর বড় নৌকাগুলো বানাতে লাগে ৬ মাস। এখন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী রাণীদিয়া গ্রামকে অনুসরণ করে অন্যান্য গ্রামের বাসিন্দারাও নৌকা ভাড়ার ব্যবসায় ঝুঁকছেন।
নৌকা ভাড়ার ব্যবসা দিয়ে শুধু যে রাণীদিয়ার চিত্র বদলেছে তা নয়, রাণীদিয়া ও আশপাশের গ্রামের অন্তত আড়াই হাজার বেকার যুবকের কর্মসংস্থান হয়েছে। প্রতিটি নৌকাতে ৬ থেকে ৭ জন যুবক শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন।
অরুয়াইল ইউনিয়নের কাকরিয়া গ্রামের নৌকা তৈরির কারিগর মো. রুবেল জানান, প্রায় ১০ বছর ধরে তিনি স্টিল বডির নৌকা তৈরির কাজ করছেন। নিজ গ্রামেই তার কর্মসংস্থান হয়েছে। প্রতি মাসে ১৫-১৬ হাজার টাকা আয় করেন তিনি।
রাণীদিয়া গ্রামের বাসিন্দা ও নৌকা মালিক আবু তালেব বলেন, আগে অরুয়াইল বাজারে আমার ফার্মেসির ব্যবসা ছিল। কিন্তু এই ব্যবসা করে বেশি টাকা আয় করা যেত না। পরবর্তীতে আমি নৌকায় বিনিয়োগ শুরু করি। এখন আমার দুটি স্টিল বডির নৌকা আছে। নৌকা দুটি দিয়ে আমার ভালোই আয় হচ্ছে।
২০-৩০ বছর আগে রাণীদিয়া গ্রামের মানুষ কৃষি কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু নৌকা ভাড়ার ব্যবসা করে সবাই এখন অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল। রাণীদিয়া গ্রামের মানুষকে অন্যান্য গ্রামের মানুষ অনেক সম্মানের চোখে দেখেন বলে জানান তিনি।
ছায়েদুর রহমান, রাণীদিয়ার সাবেক ইউপি সদস্য
স্থানীয় সমাজকর্মী মো. মনসুর আলী বলেন, নৌকা ভাড়ার ব্যবসা করে রাণীদিয়া গ্রামের বাসিন্দাদের জীবনমান অনেক উন্নত হয়েছে। বাজারের বড় মাছটা এখন রাণীদিয়ার মানুষই কিনে। অথচ এক সময় মানুষ জীবিকার তাগিদে লাঙল-জোয়াল নিয়ে মাঠে যেত।
স্থানীয় স্টিল বডি নৌযান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. রেহান উদ্দিন বলেন, আমাদের ৪০০টি নৌকা আছে। এর মধ্যে রাণীদিয়ার আছে ৩০০টি নৌকা। প্রতি মাসে কয়েক কোটি টাকা আসে এই নৌকা ভাড়ার ব্যবসা থেকে। এ ছাড়া অনেক বেকার যুবকদের আমরা নৌকায় কাজ দিয়েছি। নৌকার এই ব্যবসা করে মালিক, শ্রমিক ও কারিগররা স্বাবলম্বী হয়েছেন।
অরুয়াইল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, রাণীদিয়া গ্রামে বিভিন্ন পেশার মানুষ বসবাস করেন। এর মধ্যে অধিকাংশ মানুষের পেশা ছিল কৃষিকাজ। এখন স্টিল বডির নৌকা ভাড়ার ব্যবসা করে রাণীদিয়া গ্রামটি অর্থনৈতিকভাবে অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে।
এসপি