দুর্গে প্রার্থী নেই জাপার, চাঙ্গা বিএনপি
আওয়ামী লীগ থেকে মেয়র পদে লড়ছেন বর্তমান মেয়র হাকিবুর রহমান মাষ্টার
রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার হারাগাছ পৌর এলাকায় বইছে নির্বাচনী হাওয়া। ভোট উৎসবের আমেজ এখন ঘরে বাইরে সবখানে। চলছে প্রচার প্রচারণা। কাউন্সিলর প্রার্থীরা চষে বেড়াচ্ছেন প্রত্যেকটি ওয়ার্ড। মাঠে রয়েছে আওয়ামী লীগ মনোনীত বর্তমান মেয়র। হাল ছাড়েননি মনোনয়ন বঞ্চিত প্রার্থীও। তবে এক সময়ের দুর্গখ্যাত রংপুরে জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রার্থী না থাকা আর আওয়ামী লীগের বিরোধে বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে বিএনপি। গত নির্বাচনে এক হাজার ভোটের ব্যবধানে হেরে যাওয়া বিএনপির প্রার্থী এবার মরিয়া হয়ে আছেন।
এদিকে ২০১৬ সালের নির্বাচনের মতো এবারও হারাগাছ পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী দিতে পারেনি জাতীয় পার্টি (জাপা)। সাংগঠনিক দুর্বলতা আর দলের জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ায় প্রার্থী মনোনয়ন দিতে না পারার অন্যতম কারণ বলে দলের একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
বিজ্ঞাপন
নাম না প্রকাশের শর্তে জাতীয় পার্টির স্থানীয় নেতারা বলছেন, নির্বাচনে কেউ ঝুঁকি নিতে চান না। নৌকার বিপক্ষে ভোট করে এখন অর্থকড়ি নষ্ট করা ও জামানত হারানো ছাড়া অন্য কিছু অর্জন হবে না। তাছাড়া সারা বছর কোনো কার্যক্রম নেই, শুধু নির্বাচনের সময় মার্কা দেখে কেউ ভোট দিতে চান না। নামমাত্র কমিটি থাকলেও কার্যক্রম না থাকায় হারাগাছে প্রার্থী হতে কেউই রাজি হননি।
জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকহীন এই নির্বাচনে অংশ নেওয়া দুই শক্ত প্রার্থী ছাড়াও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তাদের সরব বিচরণ এখন ঘরে-বাইরে, হাটে-মাঠে। রাত-দিন কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে।
বিজ্ঞাপন
এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মেয়র পদে মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান মেয়র হাকিবুর রহমান মাষ্টার (নৌকা)। বিএনপির মোনায়েম হোসেন ফারুক (ধানের শীষ)। তবে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র হিসেবে মাঠে রয়েছেন পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ও সদ্য বহিষ্কৃত বিদ্রোহী প্রার্থী এরশাদুল হক এরশাদ (নারকেল গাছ)। এছাড়াও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মেয়র প্রার্থী জাহিদ হোসেন (হাতপাখা) মাঠে রয়েছেন।
শ্রমিক অধ্যুষিত বিড়ি শিল্পনগরী খ্যাত হারাগাছ পৌরসভা নির্বাচনকে ঘিরে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ভোটের আলোচনায় সরগরম থাকছে পৌর এলাকার চারপাশ। ভোট নিয়ে প্রার্থী ও কর্মী সমর্থদের মধ্যে বেড়েছে আগ্রহ। অনেকেই এখন থেকে কষছেন জয় পরাজয়ের হিসাব নিকাশ। তবে জাতীয় পার্টির প্রার্থী না থাকায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যেই মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা জমবে বলে ভোটারদের মুখে মুখে শোনা যাচ্ছে। শিক্ষিত, যোগ্য ও দক্ষ প্রার্থীকে নির্বাচিত করতে চান ভোটাররা।
৩ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার নজরুল ইসলাম বলেন, ভোট আসলে সবাই হামার খোঁজ করে। ভোট শ্যাষ তো সবার দেকা সাক্ষাতও শ্যাষ। এ্যালা যে তিন মেয়র হবার চাওছে, ওমার সবার অবস্থা ভালো। যদি ভোট ভালো হয়, তাইলে মাইনসে পছন্দমতো ভোট দিবার পাইবে। এ সময় তিনি বলেন, ‘মোর ভোট তো মুই নিজের পছন্দের প্রার্থীক দিম। কিন্তু যদি এলাকার উন্নয়ন না হয়, ভোট দিয়্যা কি হইবে। এই জনতে এবার চিন্তা করি ভোট দিম।’
ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী মোশাররফ হোসেন বলেন, পাড়া মহল্লায় আগ থেকেই বেশ কিছু উঠোন বৈঠক করেছি। সবার কাছ থেকে ভালোই সাড়া পেয়েছি। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি, স্থানীয় মুরুব্বি, যুব সমাজের অনুমতি নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছি। আশা করছি জনগণের ভোট পেয়ে এলাকার উন্নয়নে কাজ করার সুযোগ পাব।
রায়হান ইসলাম নামে এক ভোটার বলেন, বিগত সময়ে হতদরিদ্র ও অসহায় অবহেলিত মানুষেরা কাঙ্ক্ষিত নাগরিক সুযোগ সুবিধা পায়নি। এবার তারা ভেবেচিন্তে ভোট দিবে। ছোট পরিসরের এই পৌর এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসন, মাদক নিয়ন্ত্রণ করাসহ পরিকল্পিত উন্নয়ন যার মাধ্যমে হবে, তাকেই পৌরবাসী নির্বাচিত করবেন।
এদিকে হারাগাছ পৌরসভার বর্তমান মেয়র মো. হাকিবুর রহমান মাষ্টার। তিনি কাউনিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ছিলেন। বর্তমানে রংপুরের জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। নৌকা প্রতীকে আবারও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য মনোনীত এই প্রার্থী জানান, বিগত সময়ের চেয়ে তার সময়ে তিনি ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। করোনার কারণে উন্নয়ন কার্যক্রম কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তবে সবমিলে বর্তমান নির্বাচনে বিগত সময়ের উন্নয়নমূলক কাজের ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে তিনি আশাবাদী।
অপরদিকে আওয়ামী লীগ থেকে সদ্য বহিষ্কৃত এরশাদুর হক এরশাদ বলেন, দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত হলেও সাধারণ ভোটার এবং দলের বেশির ভাগ নেতাকর্মী আমার পক্ষে আছে। নির্বাচিত হলে পৌরবাসীর কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নসহ নাগরিকদের সমস্যা সমাধানে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে এটা পরিবর্তন আনতে পারব।
বিএনপির প্রার্থী মোনায়েম হোসেন ফারুক বলেন, সারাদেশের নির্বাচনই তো বলে দেয় এই নির্বাচন কমিশনের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা নেই। কিন্তু তারপরও আমরা ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি। সেই ধারাবাহিকতায় হারাগাছে দল আমাকে ধানের শীষ প্রতীক দিয়েছে। এখানে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা আছে। তবে নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হলে বিএনপির পক্ষে মানুষের রায় যাবে।
জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী এই প্রার্থী বলেন, হারাগাছে বিএনপির ভোট ব্যাংক আছে। এখানে জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য রহিম উদ্দিন ভরসার বাড়ি। তিনি এখন বেঁচে না থাকলেও তার ব্যক্তি ইমেজসহ বিএনপির শক্ত জনসমর্থন রয়েছে। তাছাড়া জাতীয় পার্টির প্রার্থী নেই, আওয়ামী লীগে কোন্দল এটা বিএনপির জন্য সুবিধার।
অন্যদিকে হারাগাছে জাতীয় পার্টি প্রার্থী দিতে না পারাকে তৃণমূলের নাজুক অবস্থাকে দুষছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। দলটির কর্মী সমর্থকদের অভিযোগ, সেখানে দলের নামমাত্র পৌর কমিটি রয়েছে। কোনো কার্যক্রম নেই। দলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের মৃত্যুর পর দলের অবস্থা আরও নাজুক হয়েছে। এখন সাংগঠনিক অবস্থা দুর্বল। গতবারের মতো এবারও একজন মেয়র প্রার্থী বাছাই করতে পারেনি। প্রার্থী দিতে না পারায় অসন্তোষ ও হতাশা সবার মধ্যে রয়েছে। মানুষ দিন দিন জাতীয় পার্টি থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
লাঙ্গলভক্ত ইব্রাহিম মিয়া বলেন, কিছুদিন আগে বদরগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনেও লাঙ্গল মার্কা ছিল না। এখন হারাগাছেও নেই। এটা যদি রংপুরের বাইরে কোথাও হত, তাহলে মানা যেত। কিন্তু জাতীয় পার্টির দুর্গখ্যাত রংপুরে যদি এমন হয়, তাহলে দলের আর কী থাকল? নির্বাচনে দলের প্রার্থী না থাকলে নেতা কর্মী, সমর্থকদের দরকার কী? জাতীয় পার্টির জেলা নেতারা ব্যর্থ বলেই এখানে গতবারের মতো এবারও কোনো প্রার্থী দিতে পারল না।
এ ব্যাপারে হারাগাছ পৌর জাতীয় পার্টির নেতারা কথা বলতে রাজি হননি। তবে রংপুর জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক হাজী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া নিয়ে দলের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু সেখানে মেয়র প্রার্থী হতে কেউ রাজি হননি। আমরা নিজেরাও চেষ্টা করে কোনো যোগ্য প্রার্থী বাছাই করতে পারিনি। সত্য কথা বলতে নির্বাচন মানে তো অনেক টাকা পয়সার হিসেব। এ কারণে এখন কেউ ঝুঁকি নিতে চায় না।
আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম ধাপে হারাগাছ পৌরসভাসহ দেশের ৩১টি পৌরসভার সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী গত ১২ ফেব্রুয়ারি প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এরপর থেকে ভোটযুদ্ধের মাঠ প্রচার প্রচারণায় সরগরম। মেয়র পদে চারজন ছাড়া ৯টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে ৪৮ জন এবং সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে ১০ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
হারাগাছ পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডের ২০টি কেন্দ্রে ইলেকট্রিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মাধ্যমে ভোট দিবেন ভোটাররা। পৌরসভায় মোট ভোটার ৪৯ হাজার ১৭ জন। এর মধ্যে নারী ভোটারের সংখ্যা ২৫ হাজার ৩২৪ এবং পুরুষ ভোটার ২৩ হাজার ৬৯৩ জন ।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এসপি