২০০৬ সালে বাবাকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের একলাশপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা শেখ রাসেল মজুমদার (৩২)। পাঁচ ভাই-বোনের সংসারে দুই বেলা ভাত জোটেনি ঠিকমতো। অর্থের অভাবে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোতে পারেননি তিনি। পরিবারের হাল ধরতে গিয়ে ২০ টাকা বেতনে চাকরি নেন। আজ তার আয় মাসে ৩ লাখ টাকা।

জানা যায়, রাসেলের বাবা মারা যান যখন, তখন তার বয়স ১৪ বছর। মা গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি হাঁস-মুরগি ও শাকসবজির বাগান করে সংসার চালাতেন। পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় সংসারের হাল ধরতে ২০ টাকা বেতনে জুতার দোকানে চাকরি নেন। ছয় মাস পর সিদ্ধান্ত নেন তিনিও জুতার ব্যবসা করবেন। ধারদেনা করে নেমে পড়লেন ব্যবসায়। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজ তিনি সফল উদ্যোক্তা। 

তার কারখানায় ৪০ জন শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এখান থেকে মাসে আয় হয় তিন লাখ টাকা। লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, কুমিল্লা, ফেনীসহ রাসেলের জুতা যায় সারা দেশে। তিনি তার কারখানার নাম দিয়েছেন ‘ইফাদ সু’।

জীবনের কঠিন বাঁক পেরিয়ে সফলতা ছুঁতে পারা শেখ রাসেল মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, এক মামার মাধ্যমে চৌমুহনীর হোসেন মার্কেটের একটি দোকানে সেলসম্যান হিসেবে চাকরি শুরু করি। আমাকে ২০ টাকা বেতন দিতেন মালিক। তখন আমার বাড়ি আসতে ১০ টাকা ভাড়া লাগত আর যেতে ১০ টাকা। আমি কাস্টমার ডেকে ডেকে জুতা বিক্রি করতাম। যখন মালিককে আমার পরিবারের দুর্দশার কথা জানাই, তিনি কোনো জবাব দেননি।

পরে আমার এক মামা নতুন এক দোকানে নিয়ে যান আমাকে। ওই মালিকের সাফ কথা, নতুন অবস্থায় আমি কাউকে বেতন দিই না। বেতন না দিলেও তিনি আমাকে পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, ঢাকা অথবা ভৈরব থেকে জুতা কিনে চৌমুহনীতে বিক্রি করলে ভালো করতে পারব। পরে ঋণ করে নেমে পড়ি জুতার ব্যবসায়।

রাসেল বলেন, টাকা ধার করে ঢাকায় গিয়ে অনেক জুতা কিনে আনি। তবে আমাদের এই অঞ্চলে চলে, এমন জুতা কিনতে পারি নাই। কিছু জুতা বিক্রি হয়, কিছু থেকে যায়। যেসব জুতা বিক্রি করেছি, সেগুলোতে আবার বাকি পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু বাড়িতে গিয়ে যখন শুরু করি, এলাকার মানুষ আমাকে ভালোভাবে গ্রহণ করে। আমিও চিন্তা করি ঘুরে দাঁড়ানোর এটাই মাধ্যম।

সরেজমিনে চৌমুহনীতে অবস্থিত ইফাদ সুজের কারখানায় দেখা যায়, পাশাপাশি তিনটি রুমে জুতা তৈরিতে কাজ করছেন কারিগররা। ট্যানারি থেকে জুতা বানানোর প্রক্রিয়াজাতকরণ আনা চামড়া প্রথমে সাইজ করে কাটা হচ্ছে। বিভিন্ন সাইজে কাটা হলে তা মেশিনের সাহায্যে ফিনিশিং দেওয়া হয়। এরপর পেস্টিং দিয়ে ডিজাইন করা ও পুডিং মারা হয়। পেস্টিং দেওয়া শেষে জুতা পুরোপুরি হয়ে গেলে রং স্প্রে করে শুকাতে দেওয়া হয়। তারপর বাজারজাত করা হয়।

নিজের প্রতিষ্ঠান ‘ইফাদ সু’র নামে জুতা তৈরির বিষয়ে শেখ রাসেল মজুমদার বলেন, যখন বুঝলাম আমি ব্যবসায়ী হতে পারব, তখন আমি আরও কিছু টাকা ধার নিয়ে ভৈরবে যাই এবং 'ইফাদ' নামে জুতা বানিয়ে বিক্রি করা শুরু করি। সেখানে থেকে নগদে জুতা কিনে চৌমুহনীতে বাকিতে বিক্রি করতাম। সপ্তাহ শেষে টাকা উঠিয়ে আবার নতুন ডিজাইনের জুতা বানাতে ভৈরবে যেতাম। এভাবে ব্যবসা করতে গিয়ে আমি অনেক টাকা ঋণী হয়ে যাই। ঋণের বিষয়টা পরিবারের কাউকে বুঝতে দিইনি। ভাবলাম আমার এ দুর্বলতা জেনে গেলে মানুষ আমাকে আগের মতো সাপোর্ট দেবে না।

ভৈরবে কাজ করতে করতে কিছু কারিগরের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক হয় তার। সেখান থেকে দুজন কারিগর চৌমুহনীতে নিয়ে আসেন তিনি। এরপর ব্যাংক থেকে তিন লাখ টাকা ঋণ নিয়ে চৌমুহনীতে জুতার কারখানা দেন। শুরু করেন জুতা বানানো। কিন্তু দুই শ্রমিক তাকে না বলেই ভৈরবে চলে যান। এতে বেকায়দায় পড়েন তিনি।

এ বিষয়ে রাসেল বলেন, কারখানা চালু কর দিয়েই তারা না বলে চলে যায়। একদিকে সবে ব্যবসা শুরু করলাম, অন্যদিকে অনেক টাকা ঋণ— সব মিলিয়ে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো। বন্ধ হয়ে যায় উৎপাদন। পরে অন্য এক কারিগর এনে আবার কারখানা চালু করি। দিন-রাত কাজ শুরু করি। আস্তে আস্তে কাস্টমার জুতা কেনা শুরু করে।

বাবার মৃত্যুর পর মা ও পাঁচ ভাই-বোনের দায়িত্ব কাঁধে এল রাসেলের। দুই বোনকে বিয়ের উপযুক্ত রেখেই তার বাবা মারা যান। আস্তে আস্তে ব্যবসায় আয় দিয়ে দুই বোনকে বিয়ে দেন। তাদের স্বামীরাও ব্যবসায়ী। দ্বিতীয় ছোট ভাই চাঁদপুরে অন্যের দোকানে কাজ করতেন। ব্যবসা শুরুর পর ছোট ভাইকে সেই কাজ থেকে এনে পড়াশোনায় যুক্ত করান। এসএসসি পাসের পর সেনাবাহিনীতে চাকরি হয় তার। এখন ছোট ভাইকে রেখেছেন তার সঙ্গে। বাবার মৃত্যুর পর স্বপ্ন দেখতেন সংসারে হাল ধরে মাকে সুখী ও খুশি করবেন। আজ তা করতে পেরে রাসেলও খুশি।

মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছি, উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে রাসেল বলেন, আমার মায়ের স্বপ্ন ছিল আমাদের মানুষ করবে। কিন্তু বাবাকে হারিয়ে মা চিন্তায় পড়ে যান। সেদিন পণ করি মাকে সুখী করব। সে মোতাবেক এগিয়েছি। বোনদের বিয়ে দিয়েছি। এক ভাইকে পড়িয়ে সেনাবাহিনীতে পাঠিয়েছি। আমি আর আমার ছোট ভাই ব্যবসা পরিচালনা করি। মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে পেরে আমি আনন্দিত।

তখন যদি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে শপথ না করতেন, আজ হয়তো প্রতিষ্ঠিত হতে পারতেন না রাসেল। ঈদে নতুন জামা কিনতে পারেননি কখনো। সেই দুঃখ-কষ্ট মনে রেখে আজ তিনি অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ান। এতিম ও পথশিশুদের মাঝে খাবার বিতরণ ও নতুন পোশাক কিনে দেন। অর্থের অভাবে বিবাহযোগ্য মেয়ের বিবাহ না দিতে পারলে সেই পরিবারের পাশে দাঁড়ান তিনি। রাষ্ট্রীয় দিবসে বিশাল আয়োজন করে শ্রমিকদের জন্য রান্নাবান্নার আয়োজন করে সবাইকে উদ্বেলিত করেন।

তিনি বলেন, নিজে কষ্ট করেছি। তাই আজ আমার এলাকার অসহায়দের পাশে দাঁড়াই। ব্যবসার শুরুতেও আমি কারখানা চালাতে গিয়ে অনেক কষ্ট করেছি। এমনও দিন গেছে খাওয়ার মতো টাকা ছিল না। কর্মচারীদের হোটেলে বা বাইরে খাওয়ালে খরচ বেশি আসবে। তাই বাড়ি থেকে মায়ের রান্না করা খাবার এনে সহকর্মীদের খাওয়াতাম।

উৎপাদন, খরচ ও লাভ বিষয়ে রাসেল বলেন, প্রতিদিন কারখানায় ৩০০ থেকে ৩৫০ জোড়া জুতা উৎপাদিত হয়। জুতার নকশা অনুযায়ী ৩০০ থেকে ৮০০ টাকা দামের জুতা তৈরি হয়। প্রতি জোড়ায় শ্রমিকদের ১৫০ থেকে ২০০ টাকা মজুরি দেন তিনি। মাসে প্রায় ৩০ লাখ টাকার জুতা বিক্রি হয় রাসেলের। এতে সব খরচ চুকিয়ে ৩ লাখ টাকা থাকে তার।

দেশি উদ্যোক্তাদের থেকে পণ্য কেনার আহ্বান জানিয়ে রাসেল বলেন, আমার লক্ষ্য ছিল ভালো মানের পণ্য বানানো। যাতে আমার ব্র‍্যান্ড সবাই চেনে। আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি এপেক্স ও বাটা থেকে মানের দিক থেকে আমার জুতার মান অনেক ভালো। দামের দিক থেকেও তিন থেকে চার গুণ কম। বর্তমানে সব কাঁচা মালের দাম বেশি হলেও জুতার তাম তেমন বাড়েনি। সে অনুযায়ী সবার উচিত দেশি পণ্য কেনা।

রাসেল তার প্রতিষ্ঠানে ১০০ শ্রমিকের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে কাজ করছেন। আগামী দিনে এই সংখ্যা এক হাজারে পৌঁছাবে বলেও আশা করেন তিনি। তাই দেশি পণ্য কিনে সহযোগিতার কথা জানান এ উদ্যোক্তা।

নিখুঁত চামড়ার জুতা কেনার বিষয়ে শেখ রাসেল মজুমদার বলেন, রং চকচকা দেখলেই সুন্দর, বিষয়টা তা নয়। আসল চামড়ার পণ্য নিতে হলে একটু ডিপ কালার নিতে হবে। নিখুঁত চামড়ার পণ্য নিতে হলে আগুন দিয়ে চেক করতে হবে। রেক্সিন হলে আগুনে পুড়ে যাবে। কিন্তু চামড়া অরজিনাল হলে কখনো আগুনে পুড়বে না।

দেশীয় বাজারের পর আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করার স্বপ্ন দেখছেন রাসেল। তিনি বলেন, আমি গুণগত মানের পণ্য উৎপাদন করি যেন মানুষ পছন্দ করে কেনেন। অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে দেশের বাজার ধরেছি। এখন আমার স্বপ্ন দেশের বাইরে জুতা রপ্তানি করার।

শেখ রাসেলের প্রতিবেশী চৌমুহনী বাজারের ব্যবসায়ী শাহেদ মুনীম ফয়সাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ইফাদ সু ও রাসেলের বেড়ে ওঠা দেখেছি নিজের চোখে। অনেক রাত কেটে দিয়েছেন কারখানায় ভালো মানের জুতা তৈরি করতে। দুমুঠো ভাত যার খেতে কষ্ট হতো, আজ তিনি সফল। রাসেলের এমন সফলতায় আমি ব্যবসায়ী হিসেবে গর্বিত।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) নোয়াখালী শিল্প নগরী কার্যালয়ের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মাহবুব উল্যাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, শেখ রাসেলের মতো অনেক উদ্যোক্তা নোয়াখালীতে আছেন। তবে রাসেলের গল্পটা অসাধারণ। তার যদি ঋণ ও জমির প্রয়োজন হয়, আমরা তার পাশে দাঁড়াব। এমন উদ্যোক্তার স্বপ্ন পূরণ হোক, আমরা এটাই চাই। রাসেলের মতো যদি আরও কেউ এগিয়ে আসেন, আমরা তাদের শিল্পবান্ধব করতে সব ব্যবস্থা নেব।

এনএ