দেশের ট্রেনযাত্রীদের কাছে পরিচিত মুখ টিপু সুলতান। তিনি নিজের লেখা বই নিজেই ট্রেনে ফেরি করে বিক্রি করেন। ঠিকাদারি ছেড়ে ট্রেনে বই বিক্রি করেই চলে তার চার সদস্যের সংসার। ২০১৭ সালে তার ‘রেলপথে বাংলাদেশ’ এবং ২০২০ সালে ‘বোনাস’ বই প্রকাশিত হয়। এ পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ কপি বই বিক্রি করেছেন বলে দাবি করেন তিনি। (তবে ঢাকা পোস্ট তার বই বিক্রির সঠিক তথ্য যাচাই করতে পারেনি)

জানা গেছে, টিপু সুলতান ১৯৭১ সালের ২৩ মে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার বোয়লিয়া ইউনিয়নের সরিষাডুলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম তাহাজ উদ্দিন বিশ্বাস এবং মায়ের নাম রমেছা খাতুন। চার ভাই বোনের মাঝে তিনি চতুর্থ। শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেছেন নিজ বাড়ি থেকে। তিনি নিজ গ্রাম সরিষাডুলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক, পাশের গ্রামের শ্যামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, চুয়াডাঙ্গা পৌর কলেজ থেকে এইচএসসি এবং মিরপুর উপজেলার আমলা সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেন। ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার প্রতি আগ্রহী ছিলেন। স্বপ্ন ছিল লেখক হবেন।  

তিনি ১৯৯৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি চাকরির উদ্দেশ্যে ঢাকায় পাড়ি জমান। ঢাকায় যাওয়ার চার দিন পর ২২ ফেব্রুয়ারি  নিউ ইস্কাটন রোডে একটি কোম্পানিতে চাকরি শুরু করেন। ১১ মাস ১০ দিন চাকরি করার পর সেতু অ্যাসোসিয়েটস নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে সিসিটিভি ও টেলিকমিউনিকেশন ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসায়ীক জীবনে ব্যস্ততার মাঝেও ২০১৭ সালে তার প্রথম বই ‘রেলপথে বাংলাদেশ’ প্রকাশিত হয়।

টিপু সুলতান দুটি বই লিখেছেন ও আটটি মানচিত্র তৈরি করেছেন। সেগুলো হলো- ভ্রমণ গাইড ‘রেলপথে বাংলাদেশ’,  প্রতিটি ইউনিয়নের পৃথক ভৌগোলিক এলাকা ও গ্রামের সঠিক অবস্থান তুলে ধরে ‘কুষ্টিয়া জেলার মানচিত্র’, ‘মেহেরপুর জেলার মানচিত্র’, প্রতিটি উপজেলার পৃথক ভৌগোলিক এলাকা ও ইউনিয়নের সঠিক অবস্থান তুলে ধরে ‘বাংলাদেশ প্রশাসনিক মানচিত্র’, ৪০৫টি নদীর গতিপথসহ বাংলাদেশের নদ-নদীর মানচিত্র, ৪৬৬টি স্টেশনের নামসহ ‘রেলপথে বাংলাদেশ মানচিত্র’, গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও ভবনের নামসহ ‘ঢাকা সিটির মানচিত্র’, ভারতের প্রতিটি প্রদেশের পৃথক ভৌগোলিক এলাকা, বিভিন্ন রাজ্যের রাজধানী, গুরুত্বপূর্ণ শহর, হাসপাতালের নাম, ঠিকানা, ই-মেইল ও টেলিফোন নম্বরসহ ‘ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থার মানচিত্র’, পৃথিবীর প্রতিটি দেশের পৃথক ভৌগোলিক এলাকা, রাজধানী ও প্রধান প্রধান শহরের নামসহ ‘পৃথিবীর মানচিত্র’ এবং ‘বোনাস’ (এনালাইসিস অফ ওয়ার্ড)।

টিপু সুলতান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি মনে করলাম, মরে যাব যে কোনো একদিন। এজন্য নিজেকে টিকিয়ে রাখা দরকার। মরার পরও মানুষের মাঝে বেঁচে থাকা যায় কিনা দেখি, মানুষের মঙ্গলের জন্য কিছু করা যায় কিনা, সেই চিন্তা থেকেই বই লেখা ও মানচিত্র তৈরি করা শুরু করি। আল্লাহর রহমতে আমি সফল। ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছি। তাছাড়া বই বিক্রি করে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সুখে-শান্তিতে আছি। নিজের লেখা বই বিক্রির মধ্যে আলাদা একটি আনন্দ আছে, শান্তি আছে। এটা বলে বোঝানো যাবে না। আমার বইয়ে মানুষের পাঠাভ্যাস গড়ে উঠেছে। পাঠকরা শিখতে পারছে, উপকৃত হচ্ছে। এটাই আমার বাড়তি পাওয়া।

তিনি বলেন, ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে ‘রেলপথে বাংলাদেশ’ বইটি ১০ হাজার পিস প্রিন্ট করলাম। তারপর বিভিন্ন রকমের লিফলেট বিতরণ করলাম, বিভিন্ন জায়গায় গেলাম, হকার খুঁজলাম, কিন্তু কোনো কাজ হলো না। বই বিক্রি হলো না। বই বিক্রি করে দেওয়ার কোনো লোক পেলাম না। বাসায় এসে বই রেখে দিলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম ফেরি করে বই বিক্রি করব। ২০১৮ সালের ১৭ জুন ঢাকা থেকে চিত্রা এক্সপ্রেস ট্রেনে উঠে বই বিক্রি শুরু করি। তার আগে আমি আমার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ক্লোজড করি। সেই যে ফেরি করে বই বিক্রি শুরু করলাম, তা আজও চালিয়ে যাচ্ছি। যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিন বইয়ের সঙ্গেই থাকব।

টিপু সুলতান বলেন, প্রথমে খুব লজ্জা লাগত। আমি একজন ব্যবসায়ী ও ঠিকাদার, আমি হকারি করে বেড়াব? আমার পরিচিত মানুষজন কী বলবে? খুব লজ্জা লাগত। মনের ভেতরে একটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব চলে আসলো যে কী হবে, ভালো বেচাকেনা হবে কিনা। এরপর আমি আমার মেয়ে, ছেলে এবং স্ত্রীর সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করলাম। তারাও রাজি হয়ে গেল। আমার ইচ্ছে ছিল ‘রেলপথে বাংলাদেশ’ বইটি ১০টাকা করে বিক্রি করব। তাতে আমার লস হয় হোক, মানুষের কাজে লাগুক। কিন্ত কেউ নিল না। সেই বইটি আমি ফেরি করে ২০ টাকায় বিক্রি করি।

তিনি বলেন, প্রথম প্রথম ট্রেনে উঠে ঠিকমতো কথা বলতে পারতাম না, লজ্জা লাগতো, বিবেকের কাছে আটকে যেতাম। ট্রেনে উঠলে আমি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতাম। এরপর আমি লজ্জা ভুলে কথা বলা শুরু করলাম, ট্রেনের যাত্রীদের হাতে হাতে বই চলে যেত, টাকাও চলে আসত। হাতে হাতে নিয়ে নিত যাত্রীরা। এখন আল্লাহর রহমতে কোনো সমস্যা নেই। 

টিপু সুলতান বলেন, আমি চিত্রা, মহানগর, সুন্দরবন, পদ্মাসহ বিভিন্ন ট্রেনে উঠে বই বিক্রি করি। সারাদেশেই বই বিক্রি করি, তবে ঢাকায় বেশি বিক্রি করি। বাসার বাইরে গেলেই আমি সঙ্গে বই রাখি। কোথাও বেড়াতে গেলে বা হাসপাতালে গেলেও সঙ্গে ব্যাগে করে বই নিয়ে যাই। সব সময় বই থাকে আমার সঙ্গে।

তিনি আরও বলেন, আমি যখন ট্রেনে বই বিক্রির জন্য কথা বলা শুরু করি, তখন ট্রেনের যাত্রীরা আমাকে ঘিরে ধরে, ভিড় জমায়। এজন্য অনেকবার কর্তৃপক্ষের বাধার সম্মুখীন হয়েছি, হেনস্তার শিকার হয়েছি, জরিমানা গুনতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, তিনবার গ্রেপ্তারও হয়েছি। কারণ বিনা টিকেটে স্টেশনে প্রবেশ করলে বা স্টেশনে কাউকে পেলে জরিমানা দিতে হয়। ট্রেন কর্তৃপক্ষের যৌক্তিকতা হলো- আমি কথা বলতে শুরু করলে ভিড় তৈরি হয়ে যায়, স্বাভাবিক পরিবেশ বিঘ্নিত হয়। আমি যখন সুযোগ পাই তখনই বই বিক্রি করতে স্টেশনে চলে যাই। কোনো নির্দিষ্ট রুটিন নেই আমার। বোনাস বইয়ের গায়ের মূল্য ২৮০ টাকা, আমি বিক্রি করি ১৫০ টাকায়। অনেকে খুশি হয়ে ৫০০ টাকা পর্যন্ত দিয়েছেন। রেলপথে বাংলাদেশ বইটির গায়ের মূল্য ৪০ টাকা, তবে আমি বিক্রি করি ২০ টাকা। খুশি হয়ে অনেকে ৫০ টাকাও দেয়।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে টিপু সুলতান বলেন, লেখালেখির ডিমান্ড বেশি বর্তমানে। বোনাস বইটির আরও কয়েকটি সিরিজ লেখব। ইংরেজি ভাষার ওপর আমি আরও কিছু বই লেখা শুরু করেছি। যেন মানুষ তা মুখস্ত না করে। দেখে দেখে শিখতে পারে। বাংলাদেশ, বিশ্ব ও ধর্ম বিষয়ক কয়েকটি বই লিখব। নতুন নতুন আরও আইডিয়া আছে। আমি যে বইগুলো লিখব, সবগুলো খুবই পাঠকপ্রিয়তা পাবে ইনশাআল্লাহ। বাংলাদেশের সকল জেলার মানচিত্র তৈরি করব।

 

এক ছেলে ও এক মেয়ে সন্তানের বাবা টিপু সুলতান। মেয়ে শালমুন সুলতান ন্যাশনাল আইডিয়াল কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছে। ছেলে তাসলিম সুলতান হিমেল স্কুল শিক্ষার্থী। পারিবারিকভাবে মাগুরার হালিমা সুলতানাকে বিয়ে করেন তিনি। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ঢাকায় বসবাস করেন। 

তিনি বলেন, বই প্রয়োজন হলে আমার মোবাইল নম্বরে ০১৭১৩৩৪০৯৬৮ যোগাযোগ করতে পারেন। আপনার ঠিকানায় বই পৌঁছে যাবে। 

টিপু সুলতানের বড় ভাই মুরাদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ছোট ভাই টিপু সুলতান পড়াশোনা শেষ করে ঢাকায় গিয়ে চাকরি করতো এবং ঠিকাদারি করতো। গত কয়েক বছর ধরে সে বই লেখালিখি করে ও মানচিত্র তৈরি করে। সে নিজের লেখা বই ও মানচিত্র  ট্রেনে-স্টেশনে ফেরি করে বিক্রি করে। সে বই বিক্রি করে ভালো আছে।

কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক নুর উদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, টিপু সুলতানকে আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি। বোনাস নামে তার যে বই আছে সেই বইটিও আমি পড়েছি। বৈচিত্র্যময় আঙ্গিকে ইংরেজি ভাষার শব্দ ভান্ডার সহজে মনে রাখার জন্য একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। বইটি অনেকের উপকারে আসতে পারে, মুখস্ত না করেও সহজে ইংরেজি ভাষার শব্দ শেখা যাবে। উনার বোনাস নামে বইটি পাঠকদের জন্য সহায়ক বই বলে আমি মনে করি। উনি উনার চিন্তা-ভাবনার জায়গা থেকে চমৎকার কাজ করছেন। 

আরএআর