প্যান্ডেল-ভর্তি দর্শক। সানাই বাজছে। লাইটের কম্পন আর ড্রামের তালে মঞ্চে প্রবেশ করলেন রাজাধিরাজ। মন্ত্রী ও সৈন্যদের হাতে ধরা পড়েছে রাজকুমারীর প্রেমিক তাজেল। টানটান উত্তেজনা আর দর্শকের উৎকণ্ঠাকে পুঁজি করে এগিয়ে চলছে গল্প। বলছিলাম বাঙালি জাতির হাজার বছরের গ্রামীণ ঐতিহ্য যাত্রাপালার কথা।

ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে গড়ে ওঠা জনপদ নরসিংদীর একসময়কার ঐতিহ্য যাত্রাপালা আজ বিলুপ্তের পথে। আশির দশকের পর নরসিংদীতে সব মিলিয়ে প্রায় ১৮টির বেশি দল থাকলেও এখন পুরোপুরি অস্তিত্ব নেই কারও।

পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, ধর্মীয় গোঁড়ামি, মোড়ে মোড়ে ডিশ অ্যানটেনার ছড়াছড়ি ও অশ্লীলতার কাছে নুয়ে পড়েছে বাঙালি জাতির লোকজ এই সংস্কৃতি। মঞ্চ থেকে হারিয়ে গেছে রূপবান-বাদশা, রহিম-রূপবান, কমলা রানীর বনবাস, নবাব সিরাজউদ্দৌলা, গুনাই বিবি, মানুষ অমানুষসহ অসংখ্য পালা। 

জানা গেছে, যাত্রাপালার সূচনা খ্রিষ্টপূর্ব কয়েক হাজার বছর আগে, যখন মানুষ দেব-দেবীর বন্দনা করত। ১৫০৯ সালে শ্রী চৈতন্যদেবের সময়ে প্রথম যাত্রায় অভিনয় যুক্ত হয় এবং অষ্টাদশ শতকে যাত্রা বাংলা ভূখণ্ডের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ঊনবিংশ শতকে পৌরাণিক কাহিনিভিত্তিক যাত্রা খুব জনপ্রিয়তা পায়। ঊনবিংশ শতকের শেষে এবং বিশ শতকের শুরুর দিকে যাত্রায় দেশপ্রেম, লোককাহিনির অভিনয় শুরু হলে গ্রামগঞ্জে বিষাদ-সিন্ধু, কারবালার কাহিনি ইত্যাদি নিয়ে যাত্রাপালা লেখা হতো।

মঞ্চে যাত্রাশিল্পীরা

যাত্রাশিল্প বিলুপ্তির পেছনে প্রিন্সেসদের আগমন ও অশ্লীলতা নিয়ে প্রশ্ন করলে যাত্রা শিল্প উন্নয়ন পরিষদের এক নেতা বলেন, যারা পেশাদার যাত্রাশিল্পী, তারা কখনো এসব অশ্লীলতা বা উলঙ্গ নৃত্যের সঙ্গে জড়িত নয়। বরং আয়োজকরাই তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থে হাউজি খেলা ও অশ্লীল নৃত্যের আয়োজন করত। যাত্রাদলে দেশজুড়ে এখনো হাজারো শিল্পী, কলাকুশলী রয়েছেন, যারা এই পেশা ছাড়া অন্য কাজ জানেন না। ফলে তাদের এখন বড়ই দুর্দিন চলছে।

এই বিষয়ে যাত্রা দলের যন্ত্রকারিগর মোহাম্মদ হাসান আলী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সারাদেশে আমার মতো অনেক শিল্পী আছেন, যারা অন্য কোনো কাজ শেখেননি। ফলে অনেকটা দুর্দশায় কাটছে আমাদের দিন। 

নব্বই দশকের শেষ দিকে নরসিংদীসহ সারাদেশের মঞ্চ কাঁপানো যাত্রাশিল্পী তাপসী রানী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা না পারছি পেটের ক্ষুধা চাপিয়ে রাখতে, না পারছি কারও কাছে হাত পাততে। শুধু বাঁচার জন্যই বেঁচে আছি। 

একসময়কার যাত্রাশিল্পী ও বর্তমানে যাত্রার পোশাক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান লোকনাথ সাজ বিতানের মালিক নুরুল ইসলাম স্বদেশ বলেন, আমি এই জগতে ১৯৮৫ সাল থেকে জড়িত। এ সময় গ্রামগঞ্জে প্রচুর যাত্রা হতো। যাত্রাকে কেন্দ্র করেই সাজ বিতান নামে ব্যবসা শুরু করি। এখন সব বিলুপ্তের পথে। আমাদের বেঁচে থাকাটাই কষ্ট হয়ে গেছে। এই বিলুপ্তের সময়ও নরসিংদীতে প্রায় তিন শতাধিক শিল্পী আছেন, যারা শুধু এই শিল্পের ওপরই নির্ভরশীল।

যাত্রাশিল্পী রুমা আক্তার বলেন, আমি অভাবের তাড়নায় এই জগতে আসি। কাজ করতে করতে এর প্রতি আমার ভালোবাসা তৈরি হয়। এর মধ্যে আমার স্বামী মারা যায়। তিনিও এই জগতের মানুষ ছিলেন। এখন আমার খুব কষ্ট হয়। আমার মতো অনেকে আছেন যাদের বাবা-মা, স্বামী নেই কিংবা এই পেশাকে ভালোবেসে জীবনে সব ত্যাগ করেছেন, তারা এখন বাসা ভাড়া, বাজার খরচ, বাচ্চার পড়াশোনার খরচ সব মিলিয়ে অসহায়।

মঞ্চে যাত্রাশিল্পী

যাত্রাশিল্পের এই দুর্দশা নিয়ে কথা হয় যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদ নরসিংদী জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি আজাদ কালামের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রশাসন এখন যাত্রার নামই শুনতে চায় না। আমরা যাত্রা মঞ্চায়নের অনুমতিই পাই না। সহজ পারমিশনের ব্যবস্থা করতে পারলে এখনো ভালো চলবে এই শিল্প। সরকারি উদ্যোগে যদি প্রতিটি জেলায় শিল্পকলা একাডেমির মাধ্যমে যাত্রার মঞ্চায়ন করার ব্যবস্থা করা যায়, তবে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব।

যাত্রাশিল্প ধ্বংস এবং এ থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে কথা হয় নরসিংদী জেলা শিল্পকলা একাডেমির নাট্যকলা বিভাগের নাট্য প্রশিক্ষক জহিরুল ইসলাম মৃধার সঙ্গে। তিনি বলেন, যাত্রাশিল্প গ্রামীণ লোকজ জীবনের ওপর ভিত্তি করে দীর্ঘকাল তার সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে। এই সাম্রাজ্য ধ্বংসের পেছনের কারণ খুঁজতে গেলে পাওয়া যাবে জুয়া এবং হাউজি খেলা, সঠিক সময়ে যাত্রার পরিবেশন সম্পন্ন না হওয়া, অশ্লীল নৃত্য এবং একই গল্প বারবার উপস্থাপন করা। 

তা ছাড়া যুগের পরিবর্তনে মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে সিনেমা হল। ফলে মানুষ আর এখন তিন-চার ঘণ্টা ধরে যাত্রা দেখতে চায় না। এ থেকে উত্তরণের মাধ্যম হিসেবে তিনি নতুন গল্পে যাত্রা নির্মাণ, সংক্ষিপ্ত পরিসর এবং ব্যাপ্তি রাখা, পুরোনো আকর্ষণীয় পালাগুলোকে নতুন করে উপস্থাপন করতে হবে।

এ বিষয়ে জেলা সংস্কৃতিবিষয়ক কর্মকর্তা শায়লা খাতুন বলেন, আমাদের বাজেট জটিলতা একটা বড় বাধা। যাত্রা নাটকের জন্য বাজেট কম থাকে। তা ছড়া বর্তমান দর্শকের রুচিরও পরিবর্তন হয়েছে। ফলে প্রচলিত রুচি বা চাহিদার সঙ্গে যাত্রাশিল্পীরা তাল মেলাতে পারছেন না। এই শিল্পকে আরেকটু আধুনিক করা গেলে দর্শক ধরে রাখা সম্ভব। 

এসপি/এনএ