‘কয়দিন থাকি হামার এত্তি তিস্তা নদীত পানি বাড়ছে। গত বছরের মতো এবারও গাবুড়া স্কুলট্যা ঝুঁকিত আছে। যেভাবে উত্তরপাশে ভাঙন শুরু হইছে, তাতে কখনবা হামার স্কুলট্যা নদীত চলি যায়। স্কুলের ছাওয়াপোয়া সবায় চিন্তাত আছে। হামার স্কুল নদীত যাওছে, বাঁচান বাহে। পুরাগ্রাম মিলি এই একটায় সরকারি স্কুল।’

তিস্তা নদীর ভাঙনের কবল থেকে রংপুরের পীরগাছা উপজেলার চর দক্ষিণ গাবুড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আকুতি জানিয়ে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন খয়বর হোসেন। বিদ্যালয়টি দ্বিতীয়বারের মতো ভাঙনের কবলে পড়েছে। ঝুঁকি নিয়ে পাঠদান কর্যক্রম চলমান থাকলেও আতঙ্কে রয়েছেন সেখানকার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। আর খয়বর হোসেনের মতো স্থানীয় বাসিন্দারাসহ  অভিভাবকরা রয়েছেন উদ্বিগ্ন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলার ছাওলা ইউনিয়ন হয়ে বহমান তিস্তা এখন পানিতে ভরপুর। নদীর বুকে শোঁ শোঁ করে পানি বয়ে যাচ্ছে গন্তব্যহীন ঠিকানায়। পানির তীব্র তোড়জোড়ে শুরু হয়েছে নদী তীরবর্তী এলাকায় ভাঙন। এতে করে ওই ইউনিয়নের দক্ষিণ গাবুড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি এখন হুমকির মুখে। বিদ্যালয়ের উত্তরপাশে মাত্র ১৫-১০ ফুট অংশ ভাঙলেই তিস্তার পেটে চলে যাবে বিদ্যালয়টি।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, চর দক্ষিণ গাবুড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি রক্ষায় গত বছর পানি উন্নয়ন বোর্ড সেখানে প্রায় ১৭ হাজার জিও ব্যাগ ফেলেছে। এ বছর সেই জিওব্যাগগুলো দেবে গিয়ে বিদ্যালয় ভবনটিকে আবারো ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। শুধু তাই নয়, পূর্বপাশে নতুন করে ভাঙন শুরু হয়েছে।

এর আগে ২০১৪ সালেও বিদ্যালয়টি ভাঙনের কবলে পড়ে বিলীন হয়েছিল। পরে স্থান পরিবর্তন করে উপজেলার ছাওলা ইউনিয়নের গাবুড়া গ্রামে নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়। কয়েক বছরের ব্যবধানে ফের বিদ্যালয়টি নদী ভাঙনের মুখে পড়েছে। বর্ষা মৌসুমে চারদিকে পানি থাকায় শিক্ষার্থীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদ্যালয়ে যাতায়াত করছে।

নদী ভাঙনের শিকার স্থানীয় বাসিন্দা গণি মণ্ডল বলেন, এখন ভাঙন ঠেকাতে না পারলে যে কোনো সময় বিদ্যালয়টি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে। কিন্তু ভাঙন যখন একটু দূরে ছিল তখন উদ্যোগ নিলে হয়তো বিদ্যালয়টি এত ঝুঁকিপূর্ণ হতো না। এখন ভাঙন কাছে আসার পর বালুর বস্তা ফেলার নামে সরকারি টাকা জলে ফেলা হচ্ছে।

চর গাবুড়াতে তিস্তা নদীর ভাঙনে গত কয়েক বছরে বিলীন হয়েছে বিদ্যালয়সংলগ্ন খয়বর হোসেন, গণি মণ্ডল, মকবুল হোসেন, জাফর আলী, ছামাদ আলী, কফের উদ্দিন, ছমের আলী, সজব উদ্দিন, আনিছুর রহমানসহ বেশ কয়েকজনের বসতবাড়ি। এই গ্রামের তিন ভাগের দুইভাগ অনেক আগেই বিলীন হয়েছে তিস্তাগর্ভে। বাকি অংশও ভাঙনের কবলে পড়ে ছোট হয়ে আসছে। এ বছরও নতুন করে ফের ভাঙন শুরু হওয়ায় সবাই এখন আতঙ্কিত। 

নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত ছামাদ আলী বলেন, আমাদের দিকে কেউ দেখে না। সময় মতো আগে উদ্যোগ নিলে প্রতি বছর এত ক্ষতি হতো না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদাসীনতার কারণে আমরা সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসেছি। গত পাঁচ বছরে এই গ্রামের প্রায় ২৫-৩০ হাজার হেক্টর ফসলি জমি, প্রায় ৫-৬ হাজার পরিবারের বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। অপরিকল্পিতভাবে দুটি বেড়িবাঁধ নির্মাণ করলেও বাঁধের পূর্বের গ্রামগুলো রক্ষা পাচ্ছে না। এখন নতুন করে ভাঙন দেখা দেওয়াতে গাবুড়া স্কুলটি বিলীন হওয়ার পথে।

এদিকে চর দক্ষিণ গাবুড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আকরাম হোসেন বলেন, জিও ব্যাগ ফেলে বিদ্যালয়টি রক্ষার চেষ্টা চলছে। তবে সিসি ব্লকের ব্যবস্থা করা গেলে স্কুলটি স্থায়ীভাবে রক্ষা করা সম্ভব।

তিনি আরও বলেন, ভাঙন ঠেকাতে না পারলে বিদ্যালয়টি যে কোনো সময় নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে। এর আগে ২০১৭ সালে পূর্ব শিবদেব চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টির দ্বিতল ভবন নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। বর্তমানে তিস্তার কোলঘেঁষা চর দক্ষিণ গাবুড়াতে ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করায় বিদ্যালয়টি আবারো হুমকির মুখে পড়েছে।

এ ব্যাপারে পীরগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ শামসুল আরেফীন বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা করা হচ্ছে। স্থায়ীভাবে ভাঙন রোধে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এজন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজনের সঙ্গে কথা হয়েছে।

রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান হাবিব বলেন, পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ভাঙন আতঙ্ক বেড়েছে। আমরা খোঁজখবর রাখছি। বিদ্যালয়টি রক্ষায় জিও ব্যাগ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ভাঙন রোধে সিসি ব্লকের জন্য আবেদন করা হয়েছে। বরাদ্দ পেলে দ্রুত কাজ শুরু করা হবে।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর