‘মা মারা গেলেও বাড়ি আসতে দেয়নি। সারাদিন কাজ করতে হত। কাজের জন্য কোনো পারিশ্রমিকও দিত না আমাকে। পেটে ভাতে কাজ করতাম। ছোট আপা প্রচুর মারধর করত। লাঠি, খুন্তি দিয়ে পেটাতো। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে এক কাপড়ে আমি পালিয়ে এসেছি। আমার মা নেই। মায়ের শেষ স্মৃতি একটা নাক ফুল আছে ওই বাসায়। আপনারা আমাকে ওইটা এনে দেন।’

 শনিবার (৮ অক্টোবর) বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বেডে শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে এভাবেই নিজের আকুতি জানাচ্ছিলেন চিকিৎসাধীন রাবেয়া আক্তার নামে এক কিশোরী। গৃহকর্তার বাড়িতে নির্যাতনের কথা বলতে গিয়ে বারবার আঁতকে উঠছিল সে।

নির্যাতনের শিকার রাবেয়া আক্তার বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার উত্তর বারইখালী গ্রামের সুলতান মোল্লার মেয়ে। ২০১৫ সালে মাত্র ১০ বছর বয়সী রাবেয়াকে একই গ্রামের জালাল হাওলাদারের মাধ্যমে খুলনার নিরালা এলাকায় অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ পরিদর্শক এসএম সামছুল হকের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজে পাঠায় তার বাবা-মা। সেখানে পাঁচ বছর কাজ করার পর রাবেয়াকে সিলেটে সামছুল হকের মেয়ে তানিয়া সুলতানা লাকির বাড়িতে পাঠানো হয়। তিন মাস পর রাবেয়াকে ঢাকার মিরপুরে ছোট বোন নাসরিন সুলতানা লিজার বাসায় পাঠিয়ে দেন লাকি। 

এতদিন ভালো থাকলেও নাসরিন সুলতানা লিজার বাসায় আসার পরে অমানবিক নির্যাতন শুরু হয় রাবেয়ার ওপর। তিন বছর নির্যাতন সহ্য করে প্রাণ বাঁচাতে শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন নিয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় গত ৫ অক্টোবর লিজার ঢাকার বাসা থেকে পালিয়ে মোরেলগঞ্জে বাবার বাড়িতে চলে আসেন রাবেয়া। পরে  শুক্রবার (৭ অক্টোবর) বিকেলে মোরেলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয় রাবেয়াকে।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রাবেয়ার হাত, পা, মুখমণ্ডল, ঘাড়-পিঠসহ বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। শারীরিকভাবে বেশ দুর্বলও সে।

মোরেলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. শর্মী রায় বলেন, ওই কিশোরীর সারা শরীরেই ক্ষতচিহ্ন আছে। এগুলো বেশ পুরাতন। শার্প কাটিং, কোনো ক্ষত নেই। সবই ব্লাংক হুইপেন (লাঠি বা এই ধরনের কিছু) দিয়ে আঘাতের চিহ্ন বলে মনে হয়েছে। সে দুর্বলতা ও শরীরের ব্যথার কথা বলেছে। এখন শারীরিকভাবে সে ভালো আছে। তবে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।

হাসপাতালের বিছানায় বসে নির্যাতনের শিকার রাবেয়া বলে, সামছুল হক স্যার ও তার বড় মেয়ে সবাই ভালো ছিল। কিন্তু তার ছোট মেয়ে অন্যরকম। প্রতিটা কাজে সময় বেঁধে দিত। একটু দেরি হলে বা ভুল হলেই মারধর, বকাবাকি করত। 

রাবেয়ার চাচা কাঞ্চন মোল্লা বলেন, গত বুধবার সকালে রাবেয়ার বাবার কাছে ফোন করে বলা হয় সে ঢাকার বাসা থেকে পালিয়েছে। কিন্তু তার আগে আমরা জানতাম-ই না, মেয়ে ঢাকায়। মেয়ে বাড়িতে আসলে, আমরা ওসি সামছুল হক স্যারকে জানাই। তিনি এসে চিকিৎসার জন্য পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছেন এবং আরও ৬০ হাজার টাকা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। আমরা এই নির্যাতনের বিচার চাই।

অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ পরিদর্শক সামছুল হক বলেন, রাবেয়া আমার মেয়ের বাসা থেকে অনেক মালামাল নিয়ে গত বুধবার পালিয়ে গেছে। মিরপুর থানায় জিডি করা হয়েছে। আপনারা শিগগিরই মোরেলগঞ্জ থানার মাধ্যমে মেইল পেয়ে যাবেন। এছাড়াও আমার মেয়ে রাবেয়াকে মারধর করেছে, তাই মানবিক কারণে মোরেলেগঞ্জে গিয়ে তার চিকিৎসার জন্য পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে এসেছি।

তানজীম আহমেদ/আরএআর