অর্থের বিনিময়ে নাটোরের এক শিক্ষিকা এমপিওভুক্ত হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। গত সেপ্টেম্বরে নাটোরের গোপালপুর ডিগ্রি কলেজের ডিগ্রি পর্যায়ের ওই শিক্ষিকা এমপিওভুক্ত হয়েছেন। তার নাম কামরুন্নাহার। 

গত জুনে তিনি এমপিও আবেদন করলেও নিবন্ধন সনদ জটিলতায় ওই সময় আবেদন বাতিল করেন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) রাজশাহীর আঞ্চলিক পরিচালক। মাউশির নির্দেশনা মেনে পরের দফা ফের আবেদন করেন কামরুন্নাহার। এরপর এমপিও পেতে শুরু হয় জোর তদবির। ওই সময় কামরুন্নাহারের মামা মকবুল হোসেন আঞ্চলিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক প্রফেসর মাহবুবুর রহমান শাহের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করেন।

তাদের সেই কথোপকথনের কল রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে। এরপরই তোলপাড় শুরু হয়েছে এই অঞ্চলের শিক্ষক মহলে। সামনে আসতে শুরু করেছে আঞ্চলিক শিক্ষা অধিদপ্তরের নানা অপকর্ম।

প্রকাশ হওয়া ওই কল রেকর্ডে উপপরিচালককে বলতে শোনা যায় ‘আমি তো ওই ফাইল ছেড়ে দিব। কিন্তু আপনি তো পরিচালক-সহকারী পরিচালক সম্পর্কে জানেন সবই। তারা এমনি এমনি কাজ করতে চান না। এইটা মূল সমস্যা। এ জন্য আপনাকে সেক্রিফাইস করতে হবে। ওটা করলেই কাজটা হয়ে যাবে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিক্ষিকা কামরুন্নাহারের মামা মকবুল হোসেন পেশায় কলেজ শিক্ষক। নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার পাঁকা মহাবিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তিনি। কথোপকথন ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে নিরুত্তর তিনি। তিনি দাবি করেন, এই কথোপকথন তার রেকর্ড করা নয়। এটি তিনি ছড়াননি।

এই শিক্ষক স্বীকার করেন, কামরুন্নাহার তার ভাগ্নি। তার বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি পদস্থ কর্মকর্তা। কলেজের পাশেই তার শ্বশুরবাড়ি। ভাগনির এমপিওর বিষয়টি তিনিই দেখভাল করতেন।

মকবুল হোসেন বলেন, গত জুন মাসে তার ভাগ্নি এমপিওভুক্তির আবেদন করেন। কিন্তু সেই আবেদন দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে ছিল। অনলাইনে তিনি দেখতে পান সেটি উপপরিচালক মাহাবুবুর রহমান শাহের কাছে আছে। পরে তার সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করেন। ফাইল ছেড়ে দিতে তিনি অর্থ দাবি করেননি বলেও স্বীকার করেন এই শিক্ষক।

যে শিক্ষককের এমপিও নিয়ে এই কথা হয়েছে সেই শিক্ষক কামরুন্নাহার জানান, কলেজশিক্ষক মকবুল হোসেন তার মায়ের ‘কাজিন’। সেই হিসেবে তাকে এমপিওর বিষয়টি দেখভাল করতে বলা হয়েছিল। তার এমপিও পেতে কোনো অর্থ খরচ করতে হয়নি।

তিনি দাবি করেন, তার এনটিআরসিএর নিবন্ধন ২০০৬ সালে। এমপিও আবেদনের পর আঞ্চলিক শিক্ষা অধিদপ্তর জানিয়েছিল তারা সনদ অনলাইনে পাচ্ছে না। কারণ ওই সময় এনটিআরসিএর অনলাইন ডাটাবেজে এই তথ্য ছিল না। পরে বিষয়টি রিভিউ করে নিষ্পত্তি হয়েছে। এই সমস্যা শুধু তার একার নয়, আরও অনেকেরই ছিল বলে দাবি করেন কামরুন্নাহার।

কামরুন্নাহারের এমপিও আবেদন যে সময় হয়েছিল, সেই সময় গোপালপুর ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন আকরাম হোসেন। এই বছরের ১৯ জুন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান।

ওই সময় প্রতিষ্ঠানটির উপাধ্যক্ষ ছিলেন নূরুন্নবী। এখন তিনি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। নূরুন্নবী বলেন, কামরুন্নাহারসহ তারা ডিগ্রি পর্যায়ের সাতজন শিক্ষকের এমপিওভুক্তির আবেদন করেছিলেন। কিন্তু কামরুন্নাহারসহ দুজনের এমপিও আবেদন প্রত্যাখ্যান হয়।

কারণ দেখানো হয়, তাদের এনটিআরসিএর নিবন্ধন সনদ সঠিক নয়। এটি যাচাইয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় অধ্যক্ষকেই। সেই হিসেবে তিনি নিজেই এনটিআরসিএ থেকে দুজনের সনদ যাচাই করে আনেন।

পরে একসঙ্গে তাদের এমপিও আবেদন করা হয়। ওই সময় একজনের আবেদন নিষ্পত্তি হলেও ঝুলে ছিল কামরুন্নাহারের আবেদন। সর্বশেষ এমপিওতে সেই আবেদনও নিষ্পত্তি হয়েছে।

এমপিওভুক্তিতে অর্থ লেনদেনের বিষয়ে জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দাবি করেন, বিধি মেনে তারা অনলাইনে আবেদন করেছিলেন। এরপর শিক্ষকরা নিজেদের মতো যোগাযোগ করে এমপিওভুক্ত হয়েছেন। তার কাছে অর্থ লেনদেনের বিষয়ে কোনো তথ্য নেই।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের রাজশাহী অঞ্চলের উপপরিচালক প্রফেসর মাহবুবুর রহমান শাহ বলেন, পরিচালক ও সহকারী পরিচালককে ফোনে না পেয়ে আমাকে প্রতিদিনই অসংখ্য শিক্ষক ফোন দেন। নিজের জায়গা থেকে শিক্ষকদের হাসিমুখে সেবা দেওয়ার চেষ্টা করি। 

তিনি বলেন, এমপিও আবেদন নিষ্পত্তি করার ক্ষমতা আমার নেই। ফলে এমপিও পাইয়ে দিতে অর্থ দাবির বিষয়টি একেবারেই ভিত্তিহীন।

ফাইল আটকে রাখার বিষয়ে তিনি বলেন, এমপিও শেষে সহকারী পরিচালক, উপপরিচালক এবং পরিচালকের কাছে কিছু ফাইল আটকে থাকে। সময় সল্পতার কারণে এটি হয়। পর্যায়ক্রমে এসব আবেদন নিষ্পত্তি করেন তারা। ওই শিক্ষকের আবেদনও এর মধ্যে থাকতে পারে।

উপপরিচালক অভিযোগ করেন, সম্প্রতি দুই দফা পরিচালক প্রফেসর ড. কামাল হোসেন এবং সহকারী পরিচালক ড. আবু রেজা আজাদের বিরুদ্ধে অনিয়মের তদন্ত হয়েছে। তারা শাস্তির মুখে পড়েছেন। এই পরিস্থিতিতে আমার নামে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। 

তবে উপপরিচালকের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের অভিযোগের বিষয়ে জানতে কয়েক দফা চেষ্টা করেও মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের রাজশাহী অঞ্চলের পরিচালক প্রফেসর ড. কামাল হোসেন ও সহকারী পরিচালক ড. আবু রেজা আজাদের মোবাইলে সংযোগ পাওয়া যায়নি। এসএমএস পাঠিয়েও তাদের সাড়া মেলেনি। ফলে এ নিয়ে তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

ফেরদৌস সিদ্দিকী/আরএআর