সবুজ ও বেগুনি রঙে জেগে উঠেছে ‘শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধু’
শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি
সুবজ ও বেগুনি ধানগাছের চারায় জেগে উঠেছে ‘শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধু’র প্রতিকৃতি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে ধানগাছ দিয়ে ১২০ বিঘা জমিতে পাখির চোখে রংতুলিতে আঁকা হয়েছে এটি। মাত্র ৩০ দিনেই ফুটে উঠেছে বঙ্গবন্ধুর মুখচ্ছবি। ধানগাছ দিয়ে বিশাল ক্যানভাসে আঁকা হয়েছে এই শস্যচিত্র।
গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে বাংলাদেশ স্থান করে বিশ্বের সর্ববৃহৎ শস্যচিত্র অঙ্কনকারী দেশ হিসেবে। সেই সঙ্গে বগুড়া জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম ‘বালেন্দা গ্রাম’ হয়ে উঠছে ইতিহাসের অংশ।
বিজ্ঞাপন
বগুড়ার শেরপুর উপজেলার ভবানীপুর ইউনিয়নের প্রত্যন্ত একটি গ্রাম বালেন্দা। গত ২৯ জানুয়ারি এই গ্রামের মাঠেই শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধু ক্যানভাসের প্রথম চারা রোপণের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। বালেন্দা গ্রামের চোখজুড়ানো দিগন্তবিস্তৃত মাঠেই তৈরি হচ্ছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধুর এই প্রতিকৃতি।
শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধু এই ব্যতিক্রম আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছে শস্যচিত্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদ। এই আয়োজনে সার্বিক সহযোগিতায় রয়েছে ন্যাশনাল অ্যাগ্রিকেয়ার। এতে ন্যাশনাল অ্যাগ্রিকেয়ারের ব্যয় হবে প্রায় দুই কোটি টাকা।
বিজ্ঞাপন
মঙ্গলবার (২ মার্চ) সরেজমিনে দেখা যায়, আদীবাসী নারী-পুরুষ কাজ করছেন জমিতে। তারা সবুজ ও বেগুনি ধানের চারার মাঝে থাকা আগাছা পরিষ্কার করছেন। চারা লাগানো হয়ে গেছে। এখন চলছে পরিচর্চা।
কথা হয় আধিবাসী কৃষক চন্দন টুডুর সঙ্গে। দিন সাড়ে ৩০০ টাকা মজুরিতে কাজ করছেন তিনি। তিনি জানান, চারা রোপণের প্রথম দিন থেকে কাজ করছেন। টানা কাজ করতে পেরে আনন্দিত তিনি। চারা বেগুনি রঙের চারা এবারই প্রথম লাগিয়েছেন। কোথায় সবুজ আর কোথায় বেগুনি ধানের চারা রোপণ করা হবে, তা আগে থেকে দাগ দেওয়া ছিল। সেই মোতাবেক চারাগুলো লাগানো হয়েছে। শতাধিক নারী-পুরুষ কাজ করেছেন এখানে। তবে এটা যে বঙ্গবন্ধুর ছবি হবে, তা বুঝিনি আগে। এখন বুঝতেছি। সত্যিই খুব ভালো বিষয়। চন্দন টুডুর মতো একই অভিব্যক্তি প্রকাশ করলেন শিল্পা রানী, শংকর টুডু, কলিমসহ আরও অনেকে।
শেরপুরের বালেন্দা গ্রামে একত্রে ১২০ বিঘা জমি কৃষকদের কাছ থেকে ৬ মাসের জন্য লিজ নেওয়া হয়েছে। এরপর সেখানে চীন থেকে আমদানি করা বেগুনি ও সবুজ (যা সোনালি বর্ণ ধারণ করবে) দুই ধরনের হাইব্রিড ধানের বীজ রোপণ করা হয়। রোপণকৃত বীজে চারা উৎপাদন করে তা দিয়ে ১২০ বিঘা জমিতে নির্দিষ্ট করে চিহ্নিত করা স্থানে বেগুনি ও সবুজ ধানের চারা রোপণ করা হয়েছে, যা পাখির চোখে (উঁচু থেকে) ৪০ একর অর্থাৎ ১২০ বিঘা জমিতে রোপণ করা ধানের দৃশ্যে ‘শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধু’র প্রতিকৃতি ধরা দিয়েছে।
শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি বাস্তবায়ন কমিটি সূত্রে জানা যায়, গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে এর আগে চীনে ২০১৯ সালে শস্যচিত্র তৈরি করা হয়েছিল, যার আয়তন ছিল ৮ লাখ ৫৫ হাজার ৭৮৬ বর্গফুট। এবার বগুড়ার প্রত্যন্ত গ্রাম বালেন্দায় যে বঙ্গবন্ধুর শস্যচিত্রটি পাখির চোখে ধরা দিতে শুরু করেছে, তার আয়তন হবে ১২ লাখ ৯২ হাজার বর্গফুট বা ১ লাখ ২০ হাজার বর্গ মিটার।
এই প্রকল্পে ভবানীপুর গ্রামের শফিকুল ইসলাম ৫ বিঘা ও মালেক আলী ৮ বিঘা জমি লিজ দিয়েছেন ৬ মাসের জন্য। ৬ মাসের জন্য বিঘাপ্রতি তারা পেয়েছেন ৯ হাজার করে টাকা। তারা জানান, শুরুতে যখন জমি লিজ দেওয়া হয়, তখন বুঝিনি কী হচ্ছে। তবে এখন বুজতে পারছি আমাদের জমিগুলোতে ইতিহাস রোপণ করা হয়েছে, যা এখন প্রতিফলিত হচ্ছে। পাখির চোখে দেখা যাচ্ছে জমিতে ফুটে উঠেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি। সত্যিই গর্বের বিষয়। এখন শুনছি এটি নাকি বিশ্বের সবচেয়ে বড় শস্যচিত্র। সারা বিশ্বের মানুষ চিনবে। আমরাও ইতিহাসের ভাগীদার হয়ে গেলাম।
চিত্রকর্মটি বাস্তবায়নকারী ন্যাশনাল অ্যাগ্রিকেয়ারের ব্যবস্থাপক আসাদুজ্জামান বলেন, ২০১৯ সালে চীনে তৈরি শস্যচিত্রটির আয়তন ছিল ৮ লাখ ৫৫ হাজার ৭৮৬ বর্গফুট। আর আমাদের এই শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতির আয়তন হবে ১২ লাখ ৯২ হাজার বর্গফুট। শস্যচিত্রটি দৈর্ঘ্য হবে ৪০০ মিটার এবং প্রস্থ হবে ৩০০ মিটার, যা হবে বিশ্বের সর্ববৃহৎ শস্যচিত্র। এই চিত্রকর্ম সম্পন্ন হলে বিশ্বের সর্ববৃহৎ শস্যচিত্র হিসেবে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে স্থান পাবে।
তিনি আরও বলেন, জাতির জনকের জন্মশতবর্ষকে স্মরণীয় করে রাখতে এবং কৃষি ও কৃষকের বঙ্গবন্ধুর বিশ্বের সর্ববৃহৎ প্রতিকৃতি তৈরির এই কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। গত ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধুর ভিডিওসহ সব দালিলিক কাগজপত্র গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে, আর আগামী ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে বিশ্বের সর্ববৃহৎ শস্যচিত্র হিসেবে উদ্বোধন করা হবে। শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধু প্রথমবারের মতো গিনেস বুকে স্থান পেয়ে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবে।
শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চিত্রকর্মটি সার্বক্ষণিক তদারকি করছেন ন্যাশনাল অ্যাগ্রিকেয়ারের কর্মকর্তা-কর্মচারী। ন্যাশনাল অ্যাগ্রিকেয়ারের সহকারী ব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, জাতির জনকের জন্মশতবর্ষকে স্মরণীয় করে রাখতে বিশেষ জাতের ধানের চাষের মাধ্যমে জাতির পিতাকে স্মরণ করার উদ্দেশ্যেই এই কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। এতে আকাশ থেকে ভূমির দিকে তাকালে ধানের জমিতে জাতির পিতার প্রতিকৃতি ফুটে উঠবে।
তিনি আরও বলেন, শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধুর প্রতিচ্ছবি তৈরি করার জন্য দুই ধরনের ধান বেছে নেওয়া হয়েছে। বেগুনি ও সোনালি রং। চীন থেকে এই ধানের জাত আমদানি করা হয়েছে। এরপর পরিকল্পনা অনুযায়ী এই নিভৃত পল্লির বালেন্দা গ্রামে ৪০ একর জমি লিজ নেওয়া হয়। পরে ন্যাশনাল ক্যাডেট কোরের সদস্যদের নিয়ে লে-আউট তৈরি করা হয়। চারা লাগানোর জন্য নির্ধারিত মাঠ প্রস্তুত করা হয়। এই কাজে ১০০ বিএনসিসি সদস্যের দল অংশ নেয়। চারা রোপণে প্রতিদিন ১২০ থেকে ১৩০ জন শ্রমিক এই চারা রোপণের কাজ করেছেন। শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি ফুটিয়ে উঠেছে। ধাপে ধাপে এটি পর্যবেক্ষণ করে সঠিক বিন্যাস নিশ্চিত করা হয়েছে। উঁচু থেকে এই ৪০ একর জমিজুড়েই রোপণ করা ধানের দৃশ্যে জাতির পিতার প্রতিকৃতি জেগে উঠতে শুরু করেছে।
গত ২৯ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে উচ্চফলনশীল দুই ধরনের ধানের চারা রোপণের মাধ্যমে এই কর্মযজ্ঞের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেন। শস্যচিত্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক কৃষিবিদ আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম এতে সভাপতি ছিলেন। এরপর থেকে চারা রোপণের মাধ্যমে দিগন্তজুড়ে মাঠের কাদার এই ক্যানভাসেই বঙ্গবন্ধুকে এঁকেছেন কিষান-কিষানিরা, বিশেষভাবে আদিবাসী সম্প্রদায়ের কিষান-কিষানিরা।
বালেন্দা গ্রামের মাঠেই কথা হয় প্রকল্পের প্রধান আশেক এ ইলাহী অনির সঙ্গে। তিনি জানান, গত বছরের এপ্রিলে এই ধারণা করা হয়। তখন থেকেই চেষ্টা চলছিল কোথায় করা হবে। বগুড়ার শেরপুরে বালেন্দা গ্রামে এই বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি শস্য চিত্র উপস্থাপন করা হবে। প্রায় দুই মাস ধরে ১০০ জন বিএনসিসি কর্মী ও ৩০ জন কৃষককে নিয়ে কাজ করা হয়েছে রোপণের আগে। ২৯ জানুয়ারি প্রথম চারা রোপণের উদ্বোধন করা হয়। ছক অনুযায়ী চারা রোপণ শেষ ফেব্রুয়ারি মাসে মাঝামাঝি। আর মার্চের প্রথম দিন থেকেই জেগে উঠেছে বা দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি। শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধুর এই প্রতিকৃতি দৃশ্যমান থাকবে আগামী ১৪৫ দিন পর্যন্ত। এটি হবে বিশ্বের সর্ববৃহৎ শস্যচিত্র, যা স্থান করে নেবে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে।
শেরপুর উপজেলার ভবানীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি এসএম আবুল কালাম আজাদ বলেন, মুজিববর্ষ উপলক্ষে আমাদের ইউনিয়নের মাটিকে বেছে নেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর বিশাল আয়তনে যে চিত্রকর্ম করা হচ্ছে, তা সত্যিই আমাদের জন্য গর্বের। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে দেশ ও জাতির জন্য এটি হবে মুজিববর্ষের শ্রেষ্ঠ উপহার।
এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে প্রত্যন্ত গ্রামে বালেন্দা। বালেন্দা গ্রামের মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছে। শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতির বিষয়টি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ ছুটে আসছে। সবাই একনজরে শস্যচিত্রে বঙ্গবন্ধুকে দেখতে আসছে।
এনএ