উপকূলে এখনো দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটেনি
দুর্গত মানুষ বসতভিটায় কবে ফিরতে পারবেন— জানেন না তারা
সাতক্ষীরার উপকূলীয় জনপদে সাইক্লোন আম্পান আঘাতের ৯ মাস অতিবাহিত হয়েছে। আম্পানকবলিত আশাশুনি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষ এখনো নদীর জোয়ার-ভাটার সাথে বসবাস করছেন। ৯ মাস অতিবাহিত হলেও বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধের অনেক জায়গা এখনো সংস্কার করা সম্ভব হয়নি।
ফলে শ্রীউলা ও প্রতাপনগর ইউনিয়নসহ বিভিন্ন এলাকায় বেড়িবাঁধের উপর টংঘর করে শত শত পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছে। দুর্গত মানুষ বসতভিটায় কবে ফিরতে পারবেন? সেটিও জানেন না তারা। অনেকের বসতভিটা ভেসে গেছে নদীর স্রোতে।
বিজ্ঞাপন
২০২০ সালের ২০ মে সাতক্ষীরায় আঘাত হানে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আম্পান। বিলীন হয়ে যায় নদীর বেড়িবাঁধ। অনেকেই হয়ে পড়েন আশ্রয়হীন। কর্মহীন হয়ে পড়েছেন অসংখ্য মানুষ। ঘরবাড়ি হারিয়ে অনেকেই অন্যত্র চলে গেছেন। আবার কাজের সন্ধানে ভারতে পাড়ি জমিয়েছেন কেউ কেউ।
২০১০ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্যমতে, সাতক্ষীরা জেলায় মোট জনসংখ্যা ১৯ লাখ ৮৫ হাজার ৯৫৯। যা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২২ লাখে। পরিবারের সংখ্যা ৪ লাখ ৬৯ হাজার ৮৯০টি। ওই পরিসংখ্যান অনুযায়ী সাতক্ষীরা জেলার ৪৬.৩০ ভাগ মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে বসবাস করেন। আর ২৯.০৭ ভাগ মানুষ অতিদরিদ্র। দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে সাতক্ষীরা অঞ্চলের মানুষ সবচেয়ে দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী।
বিজ্ঞাপন
প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার ২২ লাখ মানুষকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। ৬৪ জেলার মধ্যে সাতক্ষীরা জেলায় দরিদ্র মানুষের সংখ্যা সব চেয়ে বেশি। অথচ সিডর-আইলা-বুলবুল-আম্পানের মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় এ জেলার জন্য সরকারের অতিরিক্ত কোনো বরাদ্দ নেই।
সাতক্ষীরা উপকূলবর্তী জেলা হওয়ায় প্রতিবছর এখানকার মানুষকে কোনো-না-কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। দুর্যোগপ্রবণ জেলা হিসেবে চিহ্নিত সাতক্ষীরা। সরকারের অতিরিক্ত বরাদ্দ না থাকায় দিন দিন দরিদ্র থেকে অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। তাছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ এখনো দাঁড়াতে পারেনি মেরুদণ্ড সোজা করে।
সম্প্রতি আশাশুনির দুর্গত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, উপকূলীয় এলাকা এখনো বিধ্বস্ত। কৃষিজমি ও মৎস্য ঘের নদীর জলের সাথে মিশে একাকার।
আশাশুনির শ্রিপুর গ্রামের গফফার গাজীর স্ত্রী শাহিনা খাতুন জানান, ‘আম্পানের পর ধসে পড়া বেড়িবাঁধ মেরামতের জন্য এক সপ্তাহ কাজ করেছেন আমার স্বামী। কাজের বিনিময়ে সে সময় পৃথক দুটি স্লিপের মাধ্যমে প্রতাপনগর ইউনিয়র পরিষদ থেকে মোট ১৬ কেজি চাল ছাড়া এ পর্যন্ত কোনো সরকারি সহযোগিতা পাননি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এলাকায় কোনো কাজ নেই। কাজের সন্ধানে স্বামী গফফার ৪ মাস আগে এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। বাড়িতে ঠিকমতো টাকা পাঠান না। এখন শুনছি, রংপুর গিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করে ঘর-সংসার শুরু করেছেন। দুই ছেলে এক মেয়ে নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে আমাদের।’
প্রতাপনগর ইউনিয়নের কুড়িকাউনিয়া গ্রামের স্কুলশিক্ষক ওলিউর রহমান জানান, ‘শ্রিপুর-কুড়িকাউনিয়া ওয়ার্ডে সাড়ে ১১শ পরিবারের বসবাস। আম্পানের পরে ১৭৫ পরিবার এলাকা ছেলে চলে গেছে। এরমধ্যে অনেকেই স্ত্রী-সন্তান ফেলে অন্য জেলায় গিয়ে বিয়ে করে নতুন সংসার শুরু করেছেন। স্বামীরা প্রথম স্ত্রী, সন্তানদের খোঁজ-খবর নিচ্ছে না। ছেলে-মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার অবস্থা নেই। গ্রামের ভেতর এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে হলে একাধিক বাঁশের সাঁকো পার হয়ে যেতে হয়। গ্রামের উপর দিয়ে এখনো জোয়ার-ভাটা বইছে।’
চাকলা গ্রামের জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘ভিটেবাড়ি সবই নদীতে ভেসে গেছে। কিছুই নেই। কপোতাক্ষ নদের বেড়িবাঁধের উপর আম্পানের পর থেকে আমরা ২৫ পরিবার বাসবাস করছি। সরকারি সহায়তা হিসেবে পরিবারপ্রতি ২০ কেজি চাল ছাড়া আর কিছুই পাইনি। সেটিও ৫ দিন বাঁধ মেরামতের কাজ করার পর দিয়েছিল। অসংখ্য মানুষ তাদের বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। বসতভিটার উপর দিয়ে তৈরি হয়েছে নদী।’
‘শিক্ষা-স্বাস্থ্য-চিকিৎসা, বাসস্থানসহ সব ধরনের নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত সাতক্ষীরা উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ। দেশের অন্য জেলার তুলনায় সাতক্ষীরা অনেক পিছিয়ে। এ জেলায় নিরক্ষরতার হার অন্য জেলা থেকে ১৮ ভাগ বেশি। আর স্বাস্থ্যসেবায় অন্য জেলা থেকে ২০ ভাগ মানুষ বঞ্চিত। জেলায় তেমন উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি।’
আনিসুর রহিম, সাতক্ষীরা নাগরিক কমিটির সভাপতি
তিনি আরও বলেন, ‘যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন না হওয়ায় দিন দিন আরও পিছিয়ে পড়ছে সাতক্ষীরা। দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসনে সরকারকে শিগগির পদক্ষেপ নিতে হবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে এগিয়ে নিতে হলে প্রয়োজন অতিরিক্ত বরাদ্দ। সরকার জরুরিভাবে পদক্ষেপ না নিলে সাতক্ষীরা উপকূলীয় অঞ্চল বসবাসে অনুপযোগী হয়ে পড়বে।’
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘উপকূলীয় অঞ্চলে টেকসই বাঁধ নির্মাণ করতে পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। সেনাবাহিনী ও পানি উন্নয়ন বোর্ড যৌথভাবে উপকূলীয় অঞ্চলের বাঁধ সংস্কারে কাজ করছে। এছাড়া প্রতি বছরই দুর্যোগের আঘাতে বিধ্বস্ত হচ্ছে উপকূলীয় জনপদ। এসব জনপদের মানুষকে রক্ষায় সরকার পদক্ষেপ নিচ্ছে।’
এমএসআর