সম্ভাবনাময় পর্যটনশিল্প গঙ্গামতি

গঙ্গামতি নিঃসন্দেহে একটি সুন্দর নাম। বিশেষ করে সাহিত্যপ্রেমী ও ভ্রমণপিপাসুদের দারুণভাবে আকৃষ্ট করে নামটি। আর এ সুন্দর নামটিকে আরও সুন্দর করেছে এখানকার অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্য। প্রকৃতি নিপুণ হাতে নিখুঁতভাবে সাজিয়েছে এ চরটিকে। বিশাল আয়াতনের সবুজ বেষ্টনীর মাঝখান দিয়ে সমুদ্রমিলিত লেকটিকে বলা যায় গঙ্গামতির অলংকার। লেকের জোয়ার-ভাটায় চলা মাছ ধরার ট্রলারগুলো ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের কাছে যেন প্রমোদতরি। ট্রলারে না উঠেও তীরে বসে ঢেউয়ের সঙ্গে মনে-প্রাণে দোল খান পর্যটকরা।

গঙ্গামতি চর কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত থেকে মাত্র সাত কিলোমিটার পূর্বদিকে অবস্থিত। ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান এটি। চরজুড়ে মনোরম প্রাকৃতিক ও নৈসর্গিক সৌন্দর্য পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। এখানে রয়েছে স্বচ্ছ নীল জলরাশির একাধিক লেক আর প্রাকৃতির কারুকাজে খচিত বিশাল বেলাভূমি। গঙ্গামতির চরের লেক ধরে আসা পর্যটকদের স্পিডবোট, ট্রলার অথবা নৌকা নিয়ে ঘুরে দেখার সুযোগ রয়েছে।

খুব সকালে গঙ্গামতি সৈকতে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের বুক চিরে সূর্যোদয় দেখার অনুভূতি এনে দেয় এক স্বর্গীয় আবেশ। এ সময় সূর্য লাল আলো ছড়িয়ে দেয় গঙ্গামতির বেলাভূমিতে। সৈকতজুড়ে লাল কাঁকড়ার ছোটাছুটি উচ্ছল করে তোলে। ক্ষুদ্র কাঁকড়ার পদচিহ্ন হয়ে ওঠে নিখুঁত আলপনা। গাছে গাছে বানরের লাফালাফি, শিয়ালের ডাকাডাকি আর লুকোচুরি, শূকরের শুঁড় দিয়ে মাটির গর্তের কোঁচো ধরে খাওয়ার দৃশ্য দেখা তো সৌভাগ্যের ব্যাপার। বনমোরগের দুরন্তপনা নন্দিত করেছে গঙ্গমতি।

কেওড়া, ছইলা, গেওয়া, বাইনসহ কয়েক শ প্রজাতির গাছ চিরসবুজের বিপ্লব ঘটিয়েছে এ চরে। গাছে গাছে পাখির কলরবে মুখর থাকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল। গহিন বনের ভেতর থেকে ছোট খালগুলো লেকের সঙ্গে মিলিত হয়েছে বিভিন্ন স্থানে। জোয়ারের পানি বাগানের গাছের মূল ভিজিয়ে দেয়। ভাটার স্রোতের টানে বনের শুকনা পাতা ও গাছ থেকে জরে পড়া ফুলগুলো পাড়ি জমায় অজানা ঠিকানায়। ফলে ভাটায় সময় লেকটি আরও সুন্দর লাগে।

গঙ্গামতি সৈকত

সমুদ্রকন্যা কুয়াকাটায় এসে গঙ্গামতি না গেলে পর্যটকদের ভ্রমণ অপূর্ণ থেকে যায়। কুয়াকাটা জিরো পয়েন্ট থেকে ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলে যেতে হয় গঙ্গামতির চরে। সমুদ্রে ভাটার সময় মাইক্রোবাস নিয়েও যায় অনেকে। গঙ্গামতি গেলে অবশ্য সঙ্গে হালকা খাবার ও পানি থাকলে ভালো হয়। কারণ, ওখানে গেলে ফিরে আসতে মন চায় না কারও।

মোটরসাইকেলে ভ্রমণে আসা গিয়াস উদ্দিন ও ফাতেমা আক্তার নিলু দম্পতির সঙ্গে আলাপ হয় ঢাকা পোস্টের। তারা ঢাকার মিরপুর থেকে কুয়াকাটায় বেড়াতে এসেছিলেন। তারা জানান, গঙ্গামতি এত সৌন্দর্যমণ্ডিত একটি স্থান, চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন হতো। তারা প্রকৃতির মনোরম দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। পাশাপাশি সরকার তথা পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অবহেলা ও পরিকল্পনার অভাবে অবহেলিত থাকায় কিছুটা হতাশার সুরে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

ফরিদপুর থেকে ভ্রমণে আসা ওমর আলী গঙ্গামতি এসেছিলেন সূর্যোদয় দেখতে। তিনি বলেন, গঙ্গামতি এলাকাটি দেখে আমার কাছে মনে হচ্ছে, প্রকৃতি তার নিপুণ হাতে নিখুঁতভাবে সাজিয়েছে এটিকে। আমি নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতাম না।

বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু সরকারি নীতিনির্ধারকদের পরিকল্পনার অভাবে সম্ভাবনা অনুযায়ী এ খাতের বিকাশ আজও ঘটেনি। কবে নাগাদ কর্তৃপক্ষের নজরে আসবে, তা কেউ জানে না। এরপরও সেখানকার সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে সমৃদ্ধ পর্যটনশিল্প গড়ে তুলতে আগ্রহী কিছুসংখ্যক হাউজিং কোম্পানি শত শত একর জমি কিনছে। আর এর পেছনে কাজ করছে গঙ্গামতি থেকে কাউয়ারচর পর্যন্ত বিশাল বেলাভূমি। উপকূলীয় এ অঞ্চলে সাগর ভাঙন বা বালু ক্ষয়ের আশঙ্কা খুবই কম। ক্রমেই ওই এলাকার মানচিত্র বড় হচ্ছে। এককথায়, প্রায় ১০ থেকে ১২ কিমি দৈর্ঘ্য সৈকত এবং সবুজ বেষ্টনীতে ঘেরা গঙ্গামতি চরটি আগত দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করছে।

গঙ্গামতি সৈকত

গঙ্গামতি প্রকৃতির অপরূপ সাজে সজ্জিত হচ্ছে। গোটা গঙ্গামতি এলাকা একটি ছবির মতো জনপদ। শুধু দরকার সরকারের সুনজর। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ব্যাপক কদর বাড়বে আরও উন্নয়ন করলে। পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা ও সরকারের সিদ্ধান্তের অভাবে অপার সম্ভাবনার এ খাত জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারছে না। এই বিশাল এলাকায় পর্যটকদের দেখার মতো অনেক স্পট রয়েছে। দোলাই মার্কেট, ঝাউবাগান, বাস্তব হারাদের নীড়, গঙ্গামতির বনভূমি, কড়াইবন, ডুবোচর এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

স্থানীয় জেলে জামাল কাজী ঢাকা পোস্টকে জানান, প্রতিদিন এখানে মোটরসাইকেলে দর্শনার্থীরা ভ্রমণে আসছেন। তাদের সঙ্গে পর্যটকরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলছেন। তার ভাষায় সরকারের সুদৃষ্টি থাকলে এখানেও প্রচুর পর্যটক আসবেন এবং তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে।

সরেজমিন গেলে আপনি দেখতে পাবেন, গঙ্গামতির একটু সামনে রয়েছে বিশাল বড় একটি ডুবোচর। ভাটা হলেই নানা প্রজাতির দেশি ও অতিথি পাখি খেলা করে এখানে। তা ছাড়া হাজারো জেলে সমুদ্রে মাছ শিকার করছেন। চকচকে বালুর বেলাভূমির মাঝেমধ্যে লবণাক্ত পানির লেক দেখা যায়।

গঙ্গামতি সৈকত

অখ্যাত এই এলাকার যোগাযোগব্যবস্থার পাশাপাশি বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে পারলে আরও সৌন্দর্য ফুটে উঠবে। যোগাযোগ ও বিদ্যুতের উন্নয়ন করে ব্যাপক প্রচারণা করতে পারলে কুয়াকাটার পাশাপাশি আরেকটি বিশ্ববিখ্যাত সমুদ্রসৈকত তথা পর্যটন কেন্দ্র গড়ে ওঠার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।

পর্যটনশিল্প নিয়ে কাজ করছেন, এমন একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, এত বড় বিস্তীর্ণ এলাকা থাকা সত্ত্বেও পর্যটনশিল্প বিকাশের দায়িত্বে থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। তাই সরকারের উচিত এ খাতকে বিকশিত করা। তাহলে সরকার প্রতিবছর উপকূলীয় এলাকা থেকে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব পাবে এবং ওই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি হবে।

একুশে ফেব্রুয়ারির টানা তিন দিনের ছুটির আনন্দ উপভোগ করতে সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের বেলাভূমি কুয়াকাটা পর্যটকদের পদভারে মুখর হয়ে উঠেছিল। আর এখানে আসা পর্যটকরা প্রভাতে ছুটে যান গঙ্গামতির চরে সূর্যোদয় দেখতে। ফলে গঙ্গামতি লেকের পাড় কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। তবে গত শুক্র ও শনিবার কুয়াশার চাদরে আকাশ ঢেকে থাকায় সূর্যোদয় দেখতে পাননি ভ্রমণপিপাসুরা। এখানে ঘুরতে যাওয়া পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য সার্বক্ষণিক কাজ করছে ট্যুরিস্ট পুলিশ।

এ বিষয়ে কথা হয় ট্যুরিস্ট পুলিশ কুয়াকাটা জোনের সিনিয়র এএসপি সোহরাব হোসাইনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ২১ ফেব্রুয়ারির ছুটিতে কুয়াকাটায় বেড়াতে আসা পর্যটকরা সকালে গঙ্গামতিতে ভিড় করেছেন। তাদের নিরাপত্তার জন্য আমাদের ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছিল। এ ছাড়া প্রতিদিন সকালে ট্যুরিস্ট পুলিশের একটি দল ওখানে দায়িত্বরত থাকে।

এনএ