বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় প্রায় পাঁচ হাজার পণ্যবাহী ট্রাক

বেনাপোল স্থলবন্দরের ওপারে ভারতের পেট্রাপোল বন্দরে গড়ে ওঠা শক্তিশালী চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে ট্রাকে আমদানিপণ্য নিয়ে পেট্রাপোল বন্দরে ঢোকার আগেই চাঁদাবাজিতে মেতেছে সিন্ডিকেটটি। পার্কিংয়ের নামে বাংলাদেশি আমদানিকারকদের কাছ থেকে ট্রাকপ্রতি দুই হাজার টাকা করে নেওয়া হচ্ছে। না দিলে প্রতিটি ট্রাককে ২০ থেকে ২৫ দিন পর্যন্ত আটকে রাখছে এই সিন্ডিকেট। 

এতে বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় প্রায় পাঁচ হাজার পণ্যবাহী ট্রাক আটকা পড়েছে। ফলে দুই দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য এবং রাজস্ব আয়ে বড় ধরনের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। 

আমদানিকারকরা বলছেন, পার্কিংয়ের নামে বাংলাদেশি আমদানিকারকদের ট্রাক আটকে রাখার কারণে একদিকে যেমন পণ্যের গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে বাণিজ্য সম্প্রসারণ ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি লোকসানের মুখে পড়ে বেনাপোল বন্দর ছাড়তে শুরু করেছেন আমদানিকারকরা।

বেনাপোল বন্দর সূত্রে জানা গেছে, দেশের সবচেয়ে বড় স্থলবন্দর বেনাপোল। সড়কপথে আমদানি করা পণ্যের প্রায় ৮০ ভাগ পণ্য এই বন্দর দিয়ে আমদানি করেন আমদানিকারকরা। দেশের চলমান ১২টি স্থলবন্দরের ভেতর সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় হয় এই বন্দরে। বেনাপোল বন্দরের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার আমদানি-বাণিজ্য হয়। যা থেকে সরকার প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করে। তবে ভারত অংশে নানা অব্যবস্থাপনা আর অনিয়মে দীর্ঘদিন ধরে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে এখানকার আমদানি বাণিজ্য। 

বেনাপোল বন্দর দিয়ে প্রতিদিন সাধারণত ৭০০-৮০০ ট্রাক পণ্য ভারত থেকে আমদানি হতো। বর্তমানে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩০০-৪০০ ট্রাক। ভারত থেকে পণ্যবাহী ট্রাকগুলো পেট্রাপোলে প্রবেশের আগে ২০ দিনেরও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়। বনগাঁ ও পেট্রাপোল স্থলবন্দরে সিন্ডিকেট কর্তৃক অব্যবস্থাপনা এবং অনিয়মের কারণে অযৌক্তিক বিলম্ব বাংলাদেশি আমদানিকারকদের জন্য নতুন উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নাম না প্রকাশের শর্তে এক আমদানিকারক বলেন, সীমান্তের ওপারে বনগাঁ পৌরসভার মেয়র শংকর আঢ্য (ডাকু) ‘কালিতলা পার্কিং’ নামে একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন পার্কিং তৈরি করেছেন। সরকারি পার্কিংয়ের চেয়ে এটি আকারে বড়। তার লোকজন মোটামুটি জোর করেই আমদানি পণ্যবোঝাই ট্রাকগুলো সেখানে প্রবেশ করাচ্ছে। প্রতিদিন ট্রাক প্রতি পার্কিং খরচ নেওয়া হচ্ছে ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকা করে। সিরিয়ালের নামে বনগাঁর অধীনে বন্দরের ভারতীয় অংশে পার্কিং সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বেনাপোল বন্দরগামী পণ্যবাহী ট্রাক ২০-২৫ দিনেরও বেশি সময় ধরে আটকে রাখা হয়। অনেকে জরুরিভাবে মাল নিতে চাইলে বনগাঁ সিন্ডিকেটের সঙ্গে  ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা চুক্তি করেন। 

দেশের ৭৫ ভাগ শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাঁচামালের পাশাপাশি বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য আসে এই বন্দর দিয়ে। ওপারে পণ্য আমদানিতে দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানের ওপর এর প্রভাব পড়ছে। পণ্য বন্দরে আসতে দীর্ঘ সময় লাগায় অধিকাংশ শিল্পের কাঁচামালের অভাবে সময়মত বিদেশি ক্রেতাদের পণ্য রফতানি করতে না পরায় অর্ডার বাতিল হয়ে যাচ্ছে।  

ইন্দো-বাংলা চেম্বার অব কমার্স সাব কমিটির পরিচালক মতিয়ার রহমান জানান, বেনাপোল বন্দর দিয়ে স্থলপথে পণ্য আমদানি করতে বেনাপোলের ওপারে ভারতের পেট্রাপোল বন্দরে গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট। বনগাঁ পৌরসভার মেয়র শংকর আঢ্যের (ডাকু) নেতৃত্বে তার লোকজন প্রতিটি পণ্যবোঝাই ট্রাক থেকে চাঁদা আদায় করছে। পণ্যবোঝাই একটি ট্রাক ২০ দিন ওপারে আটকে থাকলে তাকে ৪০ হাজার রুপি পরিশোধ করতে হচ্ছে। বেনাপোলের ওপারে এখন ভয়াবহ পণ্যজট লেগেছে। প্রায় পাঁচ হাজার ট্রাক আমদানিপণ্য নিয়ে বন্দরের ওপারে বাংলাদেশে আসার অপেক্ষায় রয়েছে। এতে আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের যেমন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে, তেমনি বেড়ে যাচ্ছে আমদানি ব্যয়। ফলে এই বন্দরে রাজস্ব আদায়ও কমে যাচ্ছে।

বেনাপোল কাস্টমস হাউসের কমিশনার আজিজুর রহমান বলেন, ভারতের পেট্রাপোল কালিতলা পার্কিংয়ে বর্তমানে পাঁচ হাজার পণ্যবোঝাই ট্রাক আটকে আছে। আমরা রাজস্ব আয় ও ট্রাক সংখ্যা বৃদ্ধি করতে ভারতীয় কাস্টমস ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে যাচ্ছি। এছাড়াও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে বনগাঁও পার্কিংয়ের অনিয়মের ব্যাপারে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অনেকবার কথা বলা হয়েছে। আশা করছি দ্রুতই এর সমাধান হবে।

জাহিদ হাসান/আরএআর