মুন্সীগঞ্জের চার উপজেলার ১০ লাখ মানুষের যাতায়াতের সুবিধার্থে কেরানীগঞ্জের মোল্লারহাটে চার বছর আগে একটি সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। আট পিলারের ওপর সেতু নির্মিত হওয়ার কথা থাকলেও নদীর মধ্যের দুটি পিলার এখনো দৃশ্যমান হয়নি। ইতোমধ্যে সেতু নির্মাণের সময়সীমা একবার শেষ হয়ে দ্বিতীয়বার শেষ হওয়ার পথে। ফলে সেতুর নির্মাণকাজের গতি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন এলাকাবাসী।

জানা গেছে, মুন্সীগঞ্জ সদর, টঙ্গীবাড়ি, লৌহজং ও সিরাজদিখান উপজেলার ১০ লাখ মানুষের যাতায়াতের সুবিধার্থে ঢাকার কেরানীগঞ্জের মোল্লারহাট সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। মুন্সীগঞ্জের বেতকা চৌরাস্তা থেকে পাশের সিরাজদিখান উপজেলা হয়ে ঢাকা-মাওয়া হাইওয়ে দিয়ে ঢাকার পোস্তগোলা ব্রিজ পর্যন্ত সড়ক পথে দূরত্ব  ৪২ কিলোমিটার। আর যেতে সময় লাগে প্রায় আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা। আর একই স্থানে বেতকা হতে বালুচর মোল্লারহাট সেতু দিয়ে ঢাকার পোস্তগোলা মাত্র ১৮ কিলোমিটার। সময় লাগবে ৪০-৪৫ মিনিট। সেতুটি নির্ধারিত সময়ে নির্মাণ না হওয়ায় দুই পাড়ের লাখ লাখ মানুষকে ঝুঁকি নিয়ে ট্রলার এবং ফেরি দিয়ে নদী পারাপার হতে হচ্ছে। 

সেতুটি ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের শেষ সীমানা মোল্লাহাট ধলেশ্বরী শাখা নদীর ওপর নির্মাণ করা হচ্ছে। ২০১৮ সালের ১৮ জুন সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২৫২ মিটার দৈর্ঘ্য আর ১০ মিটার প্রস্থ সেতুর রিভাইজার হচ্ছে ৩৫২ মিটার। সেতুতে ৮টি পিলার নির্মাণ করা হবে। তার মধ্যে নদীর মধ্যে দুটি আর দুই পাড়ের ভরাট জমিতে তিনটি করে ছয়টি পিলার থাকার কথা। সেতুর নির্মাণ ব্যয় ৩৩ কোটি ২৭ লাখ ৪২ হাজার ২৮৪ টাকা। সুরমা এন্টারপ্রাইজ নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২০২০ সালের ৫ ডিসেম্বর নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। পরে আরেক দফা সময় বাড়িয়ে ১৭ নভেম্বর ২০২২ করা হলেও এখনো দৃশ্যমান হয়নি সেতুর মূল দুই পিলার।

সরেজমিনে সেতু এলাকায় দেখা যায়, নির্মাণাধীন সেতুর ধলেশ্বরী শাখা নদীর দক্ষিণ পাড়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অফিস রয়েছে। তবে ওই অফিসে গিয়ে মাত্র একজন ব্যক্তিকে পাওয়া গেলেও তিনি ওই সেতু নির্মাণের ব্যাপারে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। সেতুটি আটটি পিলারের ওপর নির্মিত হওয়ার কথা থাকলেও দুই পাড়ে তিনটি করে ছয়টি পিলার নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। তবে এখনো দৃশ্যমান হয়নি নদীর মধ্যের মূল দুই পিলার।

স্থানীয়রা জানান, সেতুটি ঘিরে রয়েছে শত শত কোটি টাকার ব্যবসা। দুই পাড়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় হাউজিং কোম্পানির প্রজেক্ট রয়েছে। তারা কম দামে জমি কেনার জন্য সেতু নির্মাণে ষড়যন্ত্র করছে। 

শারমিন নামে একজন তার বয়স্ক দাদিকে নিয়ে গিয়েছিলেন ঢাকার ফার্মগেট এলাকায় চোখের ডাক্তার দেখাতে। ঘাটের দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি ফেরি দিয়ে বাড়ি ফিরছেন তিনি। দাদিকে জাপটে ধরে ফেরির দুই পাশের রাস্তায় হেঁটে পার হচ্ছেন। তিনি বলেন, সকালে ঢাকায় গিয়েছিলাম দাদিকে ডাক্তার দেখানোর জন্য। নদীতে সেতু নির্মাণ না হওয়ায় পারাপারের জন্য একটি ফেরি থাকলেও দুই ধারে রয়েছে দীর্ঘ কাঁচা রাস্তা। ওই রাস্তায় হেঁটে পার হয়ে তারপর উঠতে হয় ফেরিতে। অসুস্থ দাদিকে নিয়ে ফেরিতে উঠতে এবং ফেরি পার হতে খুব কষ্ট হচ্ছে।

বাবুল নামে অপর যাত্রী বলেন, পদ্মা সেতু হয়ে গেল। অথচ আমাদের খালের ওপর একটি ছোট্ট সেতু দীর্ঘ দিনেরও শেষ হলো না। 

মাছ বিক্রেতা আতাউর বলেন, প্রতিদিন শনির আখড়া থেকে এ এলাকায় মাছ বিক্রি করতে আসি। ১৫ বছর ধরে এভাবেই ট্রলার দিয়ে পার হচ্ছি।

সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক মো. তপন বলেন, সেতু হলে টঙ্গীবাড়ি থেকে মানুষ ৪০ মিনিটের কম সময়ে ঢাকা যেতে পারত। কিন্তু এখন ভেঙে ভেঙে অনেক সময় লাগছে। পদ্মা সেতুর আগে এই সেতুর কাজ শুরু হয়েছে। অথচ পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হলেও ছোট্ট একটি সেতুর কাজ শেষ হচ্ছে না।

মাসুম মিয়া নামে ঠিকাদারের এক কর্মচারী বলেন, সেতু নির্মাণে আমাদের অনেক সমস্যা হচ্ছে। সমস্যা আপনাদের কাছে বলে লাভ নাই। আমাদের সমস্যা বলতে হবে ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে। আমাদের দিয়ে যদি কাজ না হয়, তাহলে ইঞ্জিনিয়ার আমাদের কাজে রাখছে কেন?

এলজিইডির কেরানীগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী কাজী মাহমুদুল্লাহ বলেন, এই সেতুর ওয়ার্ককাটার হয় ২০১৮ সালের ৩১ মে। নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের ৫ ডিসেম্বর। পরে আরেক দফা সময় বাড়িয়ে এ বছরের নভেম্বর মাসের মধ্যে ব্রিজের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এবারও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা সম্ভব হবে না। পুনরায় সময় বাড়াতে হবে।

তিনি আরও বলেন, সেতুটি নির্মাণে ৩৩ কোটি ২৭ লাখ ৪২ হাজার ২৮৪ টাকা ব্যয় হওয়ার কথা ছিল। ঠিকাদার সুরমা এন্টারপ্রাইজ সেতুর কাজ বাস্তবায়ন করেছে। তাদের ঠিকাদারের গাফিলতির কারণে কাজের গতি কম ছিল। তাছাড়া জমির অধিগ্রহণ এখনো সম্পন্ন হয়নি। জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শেষ না হওয়াতে কাজে দেরি হচ্ছে। যদি ঠিকাদার জনবল না বাড়ায়, তাহলে আগামী বছরও সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হবে না। এ বিষয়ে ঠিকাদারকে অনেকবার সতর্ক করা হয়েছে।

ব.ম শামীম/এসপি