২২ বছরেও উদীচী ট্রাজেডির বিচার হয়নি, বাড়ছে দীর্ঘশ্বাস
৬ মার্চ যশোর হত্যাকাণ্ড দিবসের আলোচনা সভায় বক্তারা বলেছেন, মামলার রাজনীতিকরণের কারণে দীর্ঘ ২২ বছরেও উদীচী ট্রাজেডির সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হয়নি। ফলে ওই ট্রাজেডির শহিদ ও আহতরা আজও ন্যায় বিচার পাননি। আর তাই নতুন করে আবার সবকিছু শুরু করতে হবে যাতে উদীচী হত্যাকাণ্ডের সঠিক তদন্ত ও সুষ্ঠু বিচার অর্জণ সম্ভব হয়।
শনিবার শহরের মুন্শি মেহেরুল্লাহ ময়দানে যশোর হত্যাকাণ্ড দিবস উপলক্ষে আলোচনা অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিবাদী কর্মসূচি পালিত হয়। সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী যশোর ময়দানের শতাব্দী বটতলে রওশন আলী মঞ্চে এসব কর্মসূচির আয়োজন করে। আলোচনার পাশাপাশি এতে প্রতিবাদী গান, উদীচী শহিদদের স্মরণে মশাল ও মোমবাতি প্রজ্জলন করা হয়।
বিজ্ঞাপন
রওশন আলী মঞ্চ লাগোয়া শহিদ স্মৃতিস্মারকে মশাল ও মোমবাতি জ্বালানো হয়। ‘ঝরেছে রক্ত ঝরুক রক্ত আমরা হারব না সাথীদের খুনে রাঙা রাজপথ আমরা ছাড়ব না’ এ স্লোগানে এবারের যশোর হত্যাকাণ্ড দিবস পালিত হয়।
আলোচনা পর্বে বক্তারা আরও বলেন, প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে দেশজুড়ে একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিল উদীচী। আর যশোর থেকে তার যাত্রা শুরু হচ্ছে। এটি বুঝতে পেরে মৌলবাদী ও জঙ্গী গোষ্ঠি উদীচীর সম্মেলনে বোমা হামলা চালায়। যাতে সাংস্কৃতিক এ আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়তে না পারে।
বিজ্ঞাপন
বক্তরা বলেন, চারপাশে বিরাজ করছে একটি ভয়ের সংস্কৃতি। আর এমন পরিস্থিতিতে সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে সবখানে ভাসিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই এমন পরিস্থিতি থেকে মুক্তির জন্য দরকার জোরাল সাংস্কৃতিক আন্দোলন।
এদিকে বিকেলে শুরু হওয়া আলোচনা সন্ধ্যা পেরিয়ে যায়। এরপর নেমে ফাল্গুন রাতের আঁধার। এসময় সাংস্কৃতিক সংগঠক, শিল্পী ও কর্মীসহ উপস্থিত নাগরিকরা রওশন আলী মঞ্চ লাগোয়া শহিদ স্মৃতিস্মারক স্থলে জড়ো হয়। সেখানে ‘এই আগুনের পরশ মণি ছোঁয়াও প্রাণে....” গানটির সাথে মশালে অগ্নি সংযোগ করেন। সেই সঙ্গে প্রজ্জলণ করা হয় মোমবাতি। এর আগে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন শহিদ স্মারকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
আলোচনা সভায় উদীচী যশোরের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহাবুবুর রহমান মজনুর সভাপতিত্ব করেন। এতে বক্তব্য রাখেন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন, ওয়ার্কার্স পার্টির (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ইকবাল কবীর জাহিদ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিবিবি) জেলা সভাপতি অ্যাডভোকেট আবুল হোসেন, সংবাদপত্র পরিষদ যশোরের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধ একরাম উদ দৌলাহ্, সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ ড. আহসান হাবীব, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট যশোরের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তরিকুল ইসলাম তারু, যশোর সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ফারাজী আহমেদ সাঈদ বুলবুল, জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাহামুদ হাসান বুলু ও উদীচীর বোমা হামলায় আহত সুকান্ত দাস।
সূচনা বক্তব্য দেন উদীচী যশোরের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদুর রহমান খান বিপ্লব। যৌথভাবে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন উদীচী যশোরের সহসাধারণ সম্পাদক শুভঙ্কর দাস গুপ্ত ও উদীচী কর্মী আলমগীর কবির।
এদিকে, শহিদ স্মৃতিস্মারকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে উদীচী জেলা শাখা, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, সুরবিতান সংগীত একাডেমি, তির্যক যশোর, বিবর্তন যশোর, সুরধুনী সংগীত নিকেতন, চাঁদের হাট, শেকড় যশোর, স্পন্দন যশোর, মুন্শি রইস উদ্দিন সংগীত একাডেমি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ জেলা শাখা, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশ ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোর টাউন হল ময়দানে উদীচীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনের অনুষ্ঠান বোমা হামলায় নিহত হন ১০ জন। তারা হলেন-নূর ইসলাম, নাজমুল হুদা তপন, সন্ধ্যা রানী ঘোষ, ইলিয়াস মুন্সী, শাহ আলম বাবুল, বাবুল সূত্রধর, শাহ আলম, বুলু, রতন রায় ও রামকৃষ্ণ। আহত হন আড়াই শতাধিক মানুষ। মামলার এই দীর্ঘসূত্রতায় নিহতদের পরিবারের সদস্যদের দীর্ঘশ্বাস বাড়ছে।
জানা যায়, ১৯৯৯ সালে উদীচীর সম্মেলনে বোমা হামলার ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা হয়। প্রথমে কোতোয়ালি পুলিশ মামলার তদন্ত শুরু করলেও পরবর্তীতে তা সিআইডির ওপর ন্যস্ত হয়। তদন্ত শেষে ওই বছরের ১৪ ডিসেম্বর বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলামসহ ২৪ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে সিআইডি। পরবর্তীতে চার্জ গঠনের সময় উচ্চ আদালতে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তরিকুল ইসলামকে এ মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। চাঞ্চল্যকর এ মামলা আদালতে গড়ানোর ৭ বছর পর ২০০৬ সালের ৩০ মে মামলার রায় প্রদান করেন আদালত। রায়ে সব আসামিকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। মামলার এমন রায়ে যশোরসহ সারাদেশের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ বিস্মিত হন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে যশোর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এম ইদ্রিস আলী বলেন, উদীচী হত্যা মামলাটি উচ্চ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। কয়েবছর ধরে অপেক্ষায় থাকলেও শুনানি হয়নি। আপিল শুনানি নিষ্পত্তি না হলে নিম্ন আদালতে বিচার কাজ শুরু সম্ভব নয়।
জাহিদ হাসান/এমএএস