কমলা যে শুধু পাহাড়ি অঞ্চলেই হয় এমন ধারণা পাল্টে দিয়ে সমতল ভূমিতে চায়না কমলা চাষ করে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিয়েছেন স্কুলশিক্ষক জাকির আহমেদ উজ্জল। শখের বশে চাষ শুরু করলেও এখন তার কমলার বাগান বাণিজ্যিক রূপ নিতে যাচ্ছে। 

জানা যায়, ২০১৯ সালে পারিবারিক নানা বাধা পেরিয়ে চুয়াডাঙ্গা থেকে গাছগুলো সংগ্রহ করেন উদ্যোক্তা জাকির আহমেদ উজ্জল। শিক্ষকতার পাশাপাশি কমলা চাষি হিসেবেও সফল হয়েছেন তিনি। দীর্ঘ তিন বছরের পরিচর্যা আর পরিশ্রমে এ বছর প্রতিটি গাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে কমলা এসেছে। বর্তমানে ফলের ভারে কমলা গাছগুলো নুয়ে পড়েছে।

জাকির আহমেদ উজ্জল নাটোর সদর উপজেলার গাজীপুর বিল এলাকার সামছুউদ্দিন আহমেদের ছেলে এবং হয়বতপুর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক।

সরেজমিনে নাটোর সদর উপজেলার গাজীপুর বিল এলাকায় দেখা যায়, প্রায় আড়াই বিঘা জমিতে শোভা পাচ্ছে ২০০ কমলাগাছ। গাছগুলোতে থোকায় থোকায় ঝুলছে চায়না জাতের কমলা। স্থানীয়ভাবে যেগুলো চায়না মোমপালিশ কমলা নামে পরিচিত।

বাগান মালিক জাকির আহমেদ উজ্জল কমলাগাছ পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। কমলার ভারে প্রতিটি গাছ নুয়ে পড়েছে। কোনো কোনো গাছে লাঠির সাহায্যে বেঁধে রাখা হয়েছে। চোখ জুড়ানো হলুদ কমলার সৌন্দর্যের সমারোহ দেখতে প্রতিদিন শত শত উদ্যোক্তা ও দর্শনার্থী ভিড় করছেন। অনেকে কমলা দেখে মুগ্ধ হয়ে ছবি ও সেলফি তুলছেন। এসব কমলা খেতে সুমিষ্ট এবং আকারেও বেশ বড়। বাগানে থাকা ফল খেয়ে সকলেই তার প্রশংসা করছেন। কয়েক দিনের মধ্যই এসব কমলা বাজারে বিক্রির উপযোগী হবে।

নাটোরের চৌরি গ্রাম থেকে সদরের গাজীপুর এলাকায় কমলা বাগান দেখতে আসা সোহেল রানা জানান, তিনি কমলা বাগান দেখতে এসে মুগ্ধ হয়েছেন। তার ধারণা ছিল না একেকটি গাছে এত পরিমাণ কমলা ধরে। প্রথমবারের মতো তিনি এই ফলের বাগান দেখলেন। তিনিও কমলা বাগান করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

দর্শনার্থী মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘নাটোরের মাটিতে যে বিদেশি ফল চাষ হচ্ছে তা দেখতে এসেছি। বাগানে এত পরিমাণ ফল এসেছে, চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। উজ্জল ভাইয়ের অসাধারণ এ উদ্যোগ দেখে মুগ্ধ হয়েছি।’

আরেক দর্শনার্থী রফিক হোসেন বলেন, ‘উজ্জল ভাই শিক্ষকতার পাশাপাশি সুন্দর কমলা বাগান তৈরি করেছেন। অনেকের মুখে শুনে আমরা বাগান পরিদর্শনে এসেছি। কমলা দেখে আশ্চর্য হয়েছি। প্রতিটি গাছে প্রচুর ফল এসেছে। আমরা বাগানের ফ্রেশ কমলা খেলাম। কমলার স্বাদ বিদেশের কমলার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।’

বাগান মালিক কৃষি উদ্যোক্তা জাকির আহমেদ উজ্জল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফলের বাগান করার অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল। পরিবারের কেউ কৃষিকাজ না করলেও আমি কৃষিকাজ করতে আগ্রহী হই। সিদ্ধান্ত নেই কমলার বাগান করার। সিদ্ধান্তের কথা পরিবারের সদস্যদের জানালে কেউই একমত হননি। কারণ নতুন এই ফল চাষে কতটুকু সফলতা আসবে তা নিয়ে সবাই দ্বিধান্বিত ছিলেন।

তিনি বলেন, এক ধরনের চ্যালেঞ্জ নিয়েই কমলা চাষ শুরু করি। দুই বছরের মাথায় অল্প ফল ধরলেও এ বছর পুরোপুরি সফলতা আসছে। উত্তরাঞ্চলের সমতল মাটিতে পাহাড়ি ফল কমলা হবে তা নিয়ে সংশয় কেটে গেছে।

তিনি আরও বলেন, প্রতিটি গাছে প্রত্যাশার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি ফল এসেছে। একেকটি গাছ দেখলে মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায়। যখন দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন কমলা বাগান দেখতে আসে, তখন নিজেকে সফল কৃষক মনে হয়।  কমলা চাষ সারা দেশের মাটিতে ছড়িয়ে দিতে পারলে কৃষিক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি হবে। এ দেশ থেকেই মানুষ কমলার স্বাদ পাবে। বেকারদেরও কর্মসংস্থান হবে।

তিনি বলেন, আমার কমলা বাগান দেখতে অনেক দূর থেকে প্রতিদিন দর্শনার্থীরা আসছেন। সবাই বাগান দেখে মুগ্ধ হয়ে প্রশংসা করছেন। অনেকেই চারা কিনতে আগ্রহী হচ্ছেন। প্রতিদিন বাগান থেকে কমলার সঙ্গে সঙ্গে চারা বিক্রি করছি। এতে আমার ভালো লাভ হচ্ছে।’

বেকার যুবকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘দেশে অনেক বেকার যুবক রয়েছে। আমি তাদের বলতে চাই, বাড়িতে বসে না থেকে নিজের জমিতেই ফল চাষ শুরু করতে পারেন। এতে যেমন আর্থিকভাবে লাভবান হবেন অন্যদিকে দেশে পুষ্টি চাহিদা মিটবে।’

নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. আব্দুল ওয়াদুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাহাড়ি জাতের কমলা নাটোরে চাষাবাদ হচ্ছে। জেলার বেশ কয়েকজন কৃষক এই ফল চাষ শুরু করেছেন। দিনে দিনে সমতলে কমলা চাষ বেশ লাভজনক হচ্ছে। নতুন নতুন কৃষি উদ্যোক্তা কমলা চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। এই ফল চাষে কৃষি বিভাগ থেকে উদ্যোক্তাদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তাই নতুন কোনো কৃষক পাহাড়ি জাতের কমলা চাষে পরামর্শের জন্য কৃষি অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন।

এসপি