মৌলভীবাজার সদর উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা স্থানীয় প্রাথমিক শিক্ষকদের কাছে আতঙ্কে পরিণত হয়েছেন। তবে এই আতঙ্ক তদারকির নয়, ঘুষ গ্রহণের।

তার এমন কর্মকাণ্ডে মৌলভীবাজার সদর উপজেলায় কর্মরত শতাধিক প্রাথমিক শিক্ষক প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে ২৬ অক্টোবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

শিক্ষকরা জানান, স্লিপ ফান্ড, ক্ষুদ্র মেরামত ও রুটিন মেইনটেন্যান্সের বরাদ্দ থেকে কমিশন দিতে হয় ওই কর্মকর্তাকে। বিদ্যালয় পরিদর্শন, মাতৃত্বকালীন ছুটি, বিদেশগমন এবং লোনের প্রত্যয়নেও ঘুষ গ্রহণ করেন মোহাম্মদ মোতাহার বিল্লাহ। ঘুষ গ্রহণ তার কাছে অনেকটা ওপেন সিক্রেট। 

অভিযোগপত্রে শিক্ষকরা বলেন, ২০১৯ সালের ১৯ আগস্ট মৌলভীবাজার সদর উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ মোতাহার বিল্লাহ যোগদান করেন। এরপর থেকেই বিভিন্নভাবে শিক্ষকদের হয়রানি করে ঘুষ গ্রহণ শুরু করেন তিনি। ছুটি মঞ্জুর করতে, চেক পাস করাতে, সার্ভিসবুকে অন্তর্ভুক্ত, ঋণের প্রত্যয়নসহ বিভিন্নভাবে শিক্ষকদের কাছ থেকে অর্থ নেন তিনি। এমনকি শোকজ ও বিভাগীয় মামলা রুজু করে চাকরিচ্যুত করারও হুমকি দেন এই কর্মকর্তা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থ বছরে প্রাথমিক শিক্ষা অফিস মেরামতের জন্য ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয় মন্ত্রণালয়। নামকাওয়াস্তে কিছু কাজ করে টাকা আত্মসাৎ করেন ওই কর্মকর্তা। এ বিষয়ে স্বীকার করে তিনি বলেন, এ টাকা থেকে অফিসের আয়ার বেতন দেওয়া হয়েছে। অফিসের ১টি নতুন টেবিল ওয়ার্ডার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ২০২১-২২ অর্থ বছরের বরাদ্দকৃত টাকা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ব্যয় করার কথা থাকলেও এখন কীভাবে নতুন টেবিল ওয়ার্ডার দেওয়া হয়েছে এর কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।
 
সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকার কথা শিক্ষকদের। সকাল ৯টার সঙ্গে সঙ্গে পরিদর্শনের নামে যেকোনো বিদ্যালয়ে উপস্থিত হন ওই কর্মকর্তা। এসময় কোনো শিক্ষককে উপস্থিত না পেলে বিকেলে দেখা করার কথা বলে দ্রুত চলে আসেন। বিকেলে উপজেলা শিক্ষা অফিসে গিয়ে দেরিতে আসা শিক্ষক কিংবা ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দেখা করে টাকা দেন। শিক্ষকদের কাছ থেকে টাকা আদায় করাই ওই কর্মকর্তার পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

টাকা দেওয়ার কথা স্বীকার করে নাম গোপন রাখার শর্তে এক সহকারী শিক্ষক বলেন, বিদ্যালয়ে আসতে আমার ২ মিনিট দেরি হয়। আমার বিদ্যালয়ের একজন ম্যাডামের ৩০ মিনিট দেরি হয়। এসময় টিও স্যার বিদ্যালয়ে ছিলেন। আমাদের না পেয়ে বিকেলে অফিসে দেখা করার কথা বলে চলে যান। পরবর্তীতে আমার বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা দেখা করে ২ হাজার টাকা দেন।
 
সদর উপজেলার আদপাশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক তাপস কান্তি পাল ঘুষ বলেন, আমি ১০ নভেম্বর ছুটিতে ছিলাম। পরবর্তীতে বলেন, আমি ছুটিতে ছিলাম না। তবে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হতে ১৫ মিনিট দেরি হয়। দেরির জন্য আমি লিখিত কারণ দর্শীয়েছি।
 
নাম গোপন রাখার শর্তে এক দপ্তরি বলেন, ৫ মাস আগে জনতা ব্যাংক মৌলভীবাজার আঞ্চলিক শাখা থেকে আড়াই লক্ষ টাকা ঋণ নেওয়ার সময় উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের কার্যালয় থেকে একটি কাগজের প্রয়োজন হয়। তখন ৫০০ টাকা দিয়ে ওই কাগজ আনতে হয়েছে। 

নাম গোপন রাখার শর্তে এক সহকারী শিক্ষক ঢাকা পোস্টকে বলেন, বেতন ভাতা বিবরণী থেকে শুরু করে অফিসে প্রত্যেকটি কাজে ঘুষ দিতে হয়। আমার বেতন ভাতা বিবরণী আনতে টাকা দিতে হয়েছে। 

তিনি বলেন, পরিদর্শনের নামে প্রতিনিয়ত শিক্ষকদের কাছ থেকে ঘুষ আদায় করছেন ওই কর্মকর্তা। এক প্রধান শিক্ষক বলেন, আমার বিদ্যালয় থেকে সহকারী শিক্ষক শরীফ উদ্দিনের মাধ্যমে স্লিপ ফান্ড হতে টিও অফিসে ৩ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। এভাবে প্রত্যেক বিদ্যালয় থেকে টাকা নেওয়া হচ্ছে। 

এদিকে সম্প্রতি উপজেলার একটি বিদ্যালয়ে (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) অনুষ্ঠান ছিল। সেখানে দাওয়াত দেওয়া হয় ওই কর্মকর্তাকে। বিদ্যালয়ের শিক্ষক খাওয়া দাওয়ারও ব্যবস্থা করেন। কিন্তু শিক্ষা কর্মকর্তাকে কোনো উপঢৌকন না দেওয়ায় অফিসে এসে রেগে যান। পরবর্তীতে ওই শিক্ষক অফিসে এসে নগদ টাকা দিয়ে খুশি করেন শিক্ষা কর্মকর্তাকে।

এ বিষয়ে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অনুষ্ঠানের কথা স্বীকার করেন এবং উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে নগদ টাকা দিয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। 

নাম গোপন রাখার শর্তে এক শিক্ষক নেতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা রীতিমতো বাণিজ্য শুরু করেছেন। বিদ্যালয় পরিদর্শনের নামে প্রকাশ্যে শিক্ষকদের কাছ থেকে টাকা আদায় করছেন। স্লিপ ফান্ড, ক্ষুদ্র মেরামত ও রুটিন মেইনটেন্যান্সের বরাদ্দ থেকেও শিক্ষা কর্মকর্তাকে ঘুষ দিতে হয়। বিদ্যালয়ের দপ্তরিদের মোটরসাইকেল দিয়ে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে যান। প্রায় দিন তিনি দিশালুক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরি শেফুলকে সঙ্গে নিয়ে কয়েকটি বিদ্যালয় পরিদর্শন করে টাকা আদায় করেন।

এ বিষয়ে দপ্তরি শেফুল তার মোটরসাইকেলে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, আমি সরকারি চাকুরি করি, শিক্ষা অফিসার ফোন দিলে বাধ্য হয়ে যেতে হয়। তেল খরচ কে দেয় জানতে চাইলে তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

এ বিষয়ে মৌলভীবাজার সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোতাহার বিল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিদিন স্কুল পরিদর্শনে যাওয়া হয় না। সকাল, বিকেল অথবা দুপুর, আমি আমার সময়মতো যাই। ইদানিং অনুপস্থিতিতের সংখ্যা কম পাওয়া যাচ্ছে। এটা তো একটা দাপ্তরিক বিষয়। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ কে কি দিলো এটা তো মন্ত্রণালয় আছে, তারা দেখবে। আমি এ বিষয়ে কথা বলতে চাই না।

এ বিষয়ে মৌলভীবাজার জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শামসুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। অভিযোগ প্রমাণিত হলে উনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

এমএএস