আল নাসিরুল্লাহ সিদ্দিকী সোহান

নীলফামারীর ডোমারের ছেলে আল নাসিরুল্লাহ সিদ্দিকী সোহান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ থেকে স্নাতক শেষ করে এখন চাকরি করছেন সর্ববৃহৎ সার্চ ইঞ্জিন ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান গুগলে। 

২০১৮ সালে স্নাতক শেষ করেই দেশের দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করেন সোহান। এরপর ২০২০ সালে মাস্টার্স করতে পাড়ি জমান জার্মানিতে। সেখানে ১ম সেমিস্টার পড়াকালীন সময়ে বিভিন্ন সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরির আবেদন করা শুরু করেন। এর মধ্যে খানিকটা বিশ্বের সর্ববৃহৎ সার্চ ইঞ্জিন ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান গুগলেও আবেদন করেন তিনি। এরপর পরীক্ষার সব ধাপ পেরিয়ে গত বছরের ৬ ডিসেম্বর গুগলের পোল্যান্ড অফিসে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার (সাইট রিলায়েবিলিটি ইঞ্জিনিয়ার) হিসেবে যোগ দেন।  

আল নাসিরুল্লাহ সিদ্দিকী সোহান ডোমার পৌর শহরের পল্টনপাড়া এলাকার হামিদার ও আয়েশা দম্পতির ছেলে। বাবা হামিদার রহমান ভূমি অফিসের সহকারী কর্মকর্তা ও মা উম্মে আয়েশা সিদ্দিকা গৃহিণী। দুই ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছোট। সোহান ডোমার বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১১ সালে এসএসসি এবং রংপুর সরকারি কলেজ থেকে ২০১৩ এইচএসসি পাস করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ থেকে ২০১৮ স্নাতক শেষ করেন। এরপর অরবিটেকস বাংলাদেশে ১১ মাস ও স্যামসাং কোম্পানিতে এক বছরের মতো সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করেন। এরপর ২০২০ সালে মাস্টার্স করতে পাড়ি জমান জার্মানিতে। সেখানে জার্মানির টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অফ ডর্টমুন্ডে ডেটা সাইন্সে স্নাতকোত্তর পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন সফটওয়্যার কোম্পানিতে খণ্ডকালীন চাকরির খোঁজ করছিলেন তিনি। এরপর খানিকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই গুগলে  চাকরি পেয়ে যান।

কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সব সময় নানা বিষয়ে সহযোগিতা পেয়েছেন বড় ভাই শাহেদ শাহরিয়ারের। তিনি বর্তমানে গুগলের ডাবলিন শাখায় কর্মরত। এরপর তার সহযোগিতা ও নির্দেশনা অনুসরণ করে নিজেকে প্রস্তুত করেন সোহান।

সোহান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার এই জার্নিতে ফাইন্যান্সিয়াল কোনো প্রতিবন্ধকতা তেমন ছিল না। আমরা হয়তো কোনো ধনী কোনো পরিবারের সন্তান না। তবে সাধ্যের মধ্যে আব্বু সব সময়ই সাপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এইচএসসি পর্যন্ত সব কিছু  ঠিকঠাকই ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর ঢাকায় প্রথম যখন গেছিলাম তখন একটু আসলে ধাক্কা খাইছি। ঢাকায় প্রথম প্রথম মানায় নিতে খুবেই কষ্ট হইছে। প্রথম দেড় বছরের বেশিরভাগ সময়ই আমি অসুস্থ থাকতাম। তারপর ধীরে ধীরে ভালোর পথে গেছে। এরপর ভালোভাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ থেকে স্নাতক শেষ করি। এরপরে অরবিটেকস বাংলাদেশে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ছিলাম ১১ মাস ও স্যামসাংয়ে ছিলাম এক বছরের বেশি সময় ধরে। তারপর আমি মাস্টার্স করার জন্য পাড়ি জমাই জার্মানিতে। সেখানে টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অফ ডর্টমুন্ডে ডেটা সাইন্সের ছাত্র ছিলাম। ১ম সেমিস্টারে বিভিন্ন কোম্পানিতে আবেদন করা শুরু করলাম। তারপর গুগলে আবেদন করি। শেষমেষ গুগল থেকে অফার পাই। আমি মূলত অফার পাই গুগল পোল্যান্ডে। এটার অফিস হচ্ছে পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ার্‌শতে। তারপর আমি জার্মানি থেকে পোল্যান্ড চলে যাই। আমার ওখানে কাজ করার প্রায় এক বছর হচ্ছে।

গুগলে চাকরি পাওয়ার প্রক্রিয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এটি বেশ দীর্ঘ এবং জটিল। গুগলের ক্যারিয়ার সাইট আছে। সেখানে প্রত্যেকটা পজিশনের জন্য পোস্ট করা থাকে। সেই পোস্ট থেকে ডিরেক্ট আবেদন করা যায়, এটা একটা মাধ্যম। আরেকটা হচ্ছে পরিচিত কেউ থাকলে তার রেফারেন্সে। যেহেতু অনেকেরই স্বপ্ন থাকে গুগলে চাকরি করার, তাই এখানে প্রতিযোগিতাও ঢের বেশি। অন্যান্য চাকরির মতো গুগলে চাকরির প্রথম শর্ত, জীবনবৃত্তান্ত জমা দেওয়া। সিভি দেওয়ার পরে তারা যদি যোগ্য মনে করে তাহলে গুগলের একজন রিক্রুটারের সঙ্গে ফোনে সাক্ষাৎকার হবে। এরপর সাক্ষাৎকার আশানুরূপ হলে ৪৫ মিনিটের একটা কোডিং রাউন্ডে অংশ নিতে হয়। এই কোডিং রাউন্ডের ফলাফল ইতিবাচক হলে শেষে ফাইনাল রাউন্ডে অংগ্রহণের সুযোগ মেলে। এটাকে অনসাইড রাউন্ডও বলে।

একটা সময় এসব সাক্ষাৎকার অফিসে গিয়ে দিতে হত। করোনার পর এসব চলে আসছে অনলাইনে। ফাইনাল রাউন্ডে আমার চারটা কোডিং সাক্ষাৎকার হইছে। আর একটা থাকে বিহ্যাভিয়্যারাল রাউন্ড হইছে। অনেকের ক্ষেত্রে আমি শুনছি তিনটা কোডিং রাউন্ডও হয়। এরপর সব পরীক্ষার ফলাফল সমন্বয় করে পাঠানো হয় গুগলের চাকরিদাতা (হায়ারিং) কমিটিতে। তারাই চুড়ান্ত প্রার্থী বাছাই করেন।

গুগলে তার কাজ সর্ম্পকে সোহান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি মূলত গুগলের ক্লাউডে কাজ করছি। গুগলের তো অনেক প্রোডাক্ট। আমি একজন সাইট রিলায়েবিলিটি ইঞ্জিনিয়ার। 

নতুন যারা টেক প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে চায়, তাদের জন্য উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, গুগলসহ বিভিন্ন টেক জায়েন্ট কোম্পানিতে কাজ করতে চাইলে প্রব্লেম সলভিং, কোডিং স্কিল ও কমিউনিকেশনে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। এজন্য নিয়মিত প্র্যাকটিস করতে হবে। বিশেষ করে সমস্যা সমাধানে পারদর্শী হয়ে উঠতে হবে। কোডিং সংক্রান্ত খুঁটিনাটি জানতে হবে। প্রচু হার্ড ওয়ার্ক করতে হবে। কেনো সর্টকাটের চিন্তা ভাবনা করা যাবে না। আরেকটা জিনিস হচ্ছে মুখস্হ বিদ্যার উপর ফোকাস করা যাবে না। সবকিছু চিন্তা করে করে এনালাইটিক্যাল মাধ্যমে আসতে হবে। সমস্যা সমাধানের চিন্তা থাকতে হবে। মানে স্যার একটা জিনিস পড়াইছে বলে আমি পারি এমনটা হওয়া যাবে না। স্যার পড়ানোর আগেই আমি নিজে একটু দেখলাম। জিনিসটা কী হতে পারে, কীভাবে এই সমস্যাটা সমাধান করা যায়। এই ধরনের মেন্টালিটি থাকতে হবে।

ডোমার বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রবিউল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের ছাত্র সোহান গুগলে কাজ করছে এটা নিশ্চয়ই আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। সোহান অত্যন্ত মেধাবী, সে স্কুলে থাকাকালীন অভ্যন্তরীণ সকল প্রতিযোগিতা অংশগ্রহণ করে মেধার প্রমাণ দিত। বিতর্ক প্রতিযোগিতা ও স্কাউটিংয়ে জাতীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণ করেছিল। শুধু সোহানই নয় আমাদের স্কুলের অনেক ছাত্রই ভালো অবস্থানে আছে। তাদের সকলকে হৃদয় থেকে দোয়া, সবাই যেন সাফল্যের উচ্চস্থানে পৌঁছাতে পারে।

শরিফুল ইসলাম/আরকে