জমিতে কাজ করছেন নারী শ্রমিকেরা

চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নের শ্রীকান্দর গ্রামের উরাঁও গোত্রের সরেস ধানুয়ার স্ত্রী হরোমনি তির্কী (৪০), রহনপুর ইউনিয়নের বংপুর গ্রামের কচ্ছ গোত্রের আনারুল শিংয়ের স্ত্রী আদরী, রামযতন শিংয়ের স্ত্রী শেফালী, মান শিংয়ের স্ত্রী সুমিত্রা রানি। তারা সকলে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বা আদিবাসী নারী। এলাকায় তাদের আরও একটি পরিচয়, তারা দিনমজুর শ্রমিক। 

এসব নারীরা সবাই বাড়ির গৃহস্থলি কাজের পাশাপাশি কাজ করেন অন্যের জমিতে। যা উপার্জন করেন, তা দিয়ে চলে সংসার। বাড়ির কাজের পাশাপাশি পুরুষ শ্রমিকদের সঙ্গে সারাদিন জমিতে কৃষিকাজ করেন তারা। কঠোর পরিশ্রম ও উর্পাজনে সংসারে পুরুষদের চেয়ে তাদের অবদানই বেশি। কাজের মান ও পরিশ্রমের দিক দিয়েও সমানতালে কাজ করেন তারা। 

এতোকিছুর পরেও আদিবাসী নারী সমাজে সে অনুযায়ী মর্যাদা ও পারিশ্রমিক পান না তারা। শিক্ষা, চিকিৎসা, সামাজিক মর্যাদা, পারিশ্রমিক সবকিছুতেই পিছিয়ে আছেন তারা। পরিশ্রম, কাজের মান ও দক্ষতা সমান থাকলেও এই নারীরা পিছিয়ে শুধুমাত্র সমাজের মানসিকতায়। এ কারণেই বেতন বৈষম্য রয়েছে নারী-পুরুষ শ্রমিকদের মাঝে। 

সংসারের যাবতীয় কাজ সামলানো, ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পাঠানো, রান্না করাসহ বাড়ির সব কাজ করে বাইরে কাজে যেতে হয় তাদের। প্রায় সমান সময় ও পরিশ্রম দিয়ে কাজ করলেও বেতন বৈষম্যের চরম ক্ষোভ তাদের মাঝে। এর জন্য তারা দায়ী করেন, আদিবাসী নারী-পুরুষ ও মহাজনদের মানসিকতাকে। 

ধান-গম কাটা ও লাগানো, জমি নিড়ানি দেওয়া, ধান মাড়ার কাজ করেন নারী শ্রমিকরা। ধান কাটা ও লাগানোর মৌসুমে পুরুষ শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৪৫০-৫৫০ টাকা হলেও নারী শ্রমিকরা পায় ২৫০-৩৫০ টাকা করে। অথচ এক সঙ্গে একই সময়ে একই কাজ করেন নারী ও পুরুষ শ্রমিকরা। 

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বা আদিবাসী নারী হরোমনি তির্কী ঢাকা পোস্টকে নিজের দৈনিক কাজের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, সকালে ঘুম থেকে উঠেই ঘর পরিষ্কার করার পর রান্না করি। তখনও স্বামীরা ঘুমিয়ে থাকে। এর মধ্যে রান্না শেষে ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর ব্যবস্থা করি। পরে নিজে খেয়ে পুরুষ শ্রমিকদের সঙ্গে সকাল ৮টার মধ্যেই জমিতে যাই। জমিতে কাজের বিরতি দিয়ে দুপুরে এসে রান্না করে আড়াইটার দিকে আবার কাজে যোগ দেই। সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে কাজ। 

হরোমনি তির্কী আরও বলেন, আমাদের সমাজে পুরুষদের থেকে নারীরা অনেক পিছিয়ে আছে। তবে তা শুধু মনের দিক থেকে। কারণ পুরুষরা শুধু জমিতে কাজ করে। কিন্তু আমরা বাড়ির সব কাজ করি ও জমিতেও কাজ করি। এরপরেও মজুরি কম পাই। এমনকি ধানকাটা ও লাগানোর মৌসুমে কাজ করেও অনেক ঘুরে ঘুরে মজুরি পাওয়া যায় না। অন্য সমাজের নারীদের থেকে আদিবাসী নারীরা মজুরি ছাড়াও সামাজিক মর্যাদা ও পড়াশোনায় অনেক পিছিয়ে আছে। 

ধানকাটার ফাঁকে শ্রীমতি সাজু লাকড়া বলেন, মনের দুর্বলতার কারণেই আমাদের সমাজের নারীরা পিছিয়ে আছে। আমরা যদি শিক্ষার সুযোগ পেতাম, আর্থিক অবস্থার উন্নতি হতো, তাহলে হয়তো আদিবাসী নারীদের এভাবে অবহেলিত অবস্থায় জমিতে কাজ করতে হতো না। আমাদের জন্য কথা বলার কেউ নাই। 

সুমিত্রা রানি জানান, কৃষি কাজ করতে আমাদের জীবনটাই শেষ হয়ে গেল। থাকার জায়গা-জমি নাই। তাই বাধ্য হয়েই স্বামীদের সাথে কৃষি জমিতে কাজ করতে হয়। তারপরেও ঠিকমতো কাজ পাইনা। স্বামী ও আমাদের মিলে উর্পাজন করা টাকায় সংসার চলে। এতো কঠোর পরিশ্রমের পরেও কোনো উন্নতি হয় না আমাদের। খাটতে খাটতে এভাবেই দিন চলে যাচ্ছে। 

আদিবাসী নারী শেফালী বলেন, বিকল্প কোনো উপায় না থাকায় পুরুষ শ্রমিকদের সঙ্গে কম পারিশ্রমিকেই কাজ করতে হয়। অথচ এতো কাজ বা পরিশ্রম করেও নিজেদের নায্য অধিকার পাই না। পুরুষরা যতটুকু কাজ করে আমরাও ঠিক ততোটুকুই কাজ করি। কিন্তু মজুরি পাই অনেক কম। সরকারের তেমন সাহায্য সহযোগিতাও পাই না আমরা। আমাদের দিকে কেউ নজর দেয় না। 

জমির মালিক দূরুল হোদা জানান, পুরুষ শ্রমিকদের মতোই একই সময়ে কাজ শুরু করে একই সময়ে শেষ করে। তাদেরকে দেখে কষ্ট হয়। আদিবাসী নারীরা খুবই পরিশ্রমী। তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ করছি। কারণ তারা খুবই অসহায়। এভাবেই তাদের বেতন বৈষম্য চলে আসছে, তাই আমরাও কম পারিশ্রমিক দিয়ে কাজ করিয়ে নেই। 

আদিবাসী নারীদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা জানান গোমস্তাপুর উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নের তেঘরিয়া খোলাভিঠা গ্রামের শাব্দুল (৫০)। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, জমির মালিকের সাথে মৌসুম শুরুর আগেই আলাদাভাবে যোগাযোগ করে ধানকাটা বা লাগানোর কাজ করেন তারা। এমনকি আমাদের সঙ্গেও কাজ করে। ধান লাগানো, কাটা, নিড়ানি দেওয়া, মাড়াসহ সব কাজ করে। অন্য সম্প্রদায়ের নারীদের থেকে তারা খুব বেশি পরিশ্রমী। আমাদের বাড়ির নারীরা শুধু রান্নাবান্নার কাজ করলেও তারা এসবের পাশাপাশি জমিতে কাজ করে সংসারে অবদান রাখে। তবে সে অনুযায়ী মজুরি পায় না। 

জাতীয় মহিলা সংস্থা চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শাখার চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট ইয়াসমিন সুলতানা রুমা জানান, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারীরা খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠেন। বাড়ির সব কাজ শেষ করে জমিতে কাজ করতে যান। সারাদিন পুরুষ শ্রমিকদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করেন৷ একই পরিমাণ সময় ও শ্রম দিলেও মজুরির দিক থেকে তাদেরকে অর্ধেক দেওয়া হয়। এর জন্য তাদের অসচেতনতা যেমন কাজ করে, তেমনি সমাজের পুরুষ ও জমির মালিকরাও দায়ী। 

তিনি আরও বলেন, তারা তাদের ভাষা সমস্যাকে অন্যতম প্রধান সমস্যা মনে করে। এমনকি ধান লাগানোর ক্ষেত্রে এখন নারী শ্রমিকদেরই চাহিদা বেশি। কারণ জমির মালিকরা কম পারিশ্রমিক দিয়ে তাদরকে কাজ করিয়ে নিতে পারেন। আমাদের তাদের বিষয়ে মানবিকবোধ বাড়ানো দরকার। মূলধারায় রয়েছে এমন ব্যক্তিদেরকে তাদের পাশে দাঁড়ানো দরকার। তাদেরকে বোঝাতে হবে, অন্য সম্প্রদায়ের মতো তারাও সমাজে সমান অধিকার পাবে। 

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. জাকিউল ইসলাম মুঠোফোনে ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনগ্রসর সম্প্রদায়কে এগিয়ে নিতে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাদের উন্নয়নে রাষ্ট্র, সরকার ও প্রশাসন কাজ করছে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারীদের এগিয়ে নিতে কাজ করছে সরকার। কোনোভাবে তারা নির্যাতিত হলে বা মজুরি বৈষম্যের শিকার হলে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নারী-পুরুষ সমতা প্রধানমন্ত্রী স্বীকৃত নীতি। এতে বেতন বৈষম্যের কোনো সুযোগ নেই। 

জাহাঙ্গীর আলম/আরকে