করোনাকালীন মানুষের উপকার করতে পেরে সব কষ্ট ভুলে গেছি
চারদিকে হঠাৎ নিস্তব্ধতা। প্রকৃতিও বদলে যাচ্ছিল। প্রকৃতির রং-রূপ-রস-গন্ধ ঠিক উপভোগ করা যাচ্ছিল না। মানুষের মধ্যে এক অজানা আতঙ্ক গেড়ে বসেছে। গা-ঘেঁষাঘেঁষি থাকা জীবনগুলোয় হঠাৎ পড়ল ছেদ। গড়ে উঠল দূরত্বের দেয়াল। পরিবার-স্বজন-সহকর্মী-বন্ধু— মনে হলো কেউ কারও নয়। ক্ষণে ক্ষণে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়া মানুষগুলো হয়ে গেল ঘরবন্দী। যদিও কোথাও যেতে হয়েছে, ভয়ে মন ছিল দুরুদুরু। এলোমেলো মানুষগুলো হঠাৎ চলে এল নিয়মের মধ্যে। অফিস-আদালতে ঢুকতে হয়েছে ইনফ্রারেড থার্মোমিটারে তাপমাত্রা মেপে, হাত স্যানিটাইজ ও বডি স্প্রে করে। বাইরে যাদের যেতেই হয়েছে, মাস্ক-গ্লাভস রোজকার পোশাকের অংশই হয়ে গেল তাদের।
মহামারি করোনাভাইরাস। সংক্রমণের এই কঠিন দুর্যোগে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষ এমনভাবেই লড়াই করেছে, নিয়ম ভেঙেছে, ঝুঁকিতে পড়েছে, অসুস্থ হয়ে মারা গেছে। প্রায় একটি বছর ধরে করোনাবিরোধী সংগ্রামে যুদ্ধ করেছেন বাংলাদেশের মানুষ। আর প্রথম সারির যোদ্ধা হিসেবে যারা ছিলেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিতে ছিলেন চিকিৎসকরা।
বিজ্ঞাপন
ডা. সুজাউদ্দৌলা রুবেল ও ডা. সাজেদা বেগম পলিন দম্পতি প্রথম সারির তেমনই এক যোদ্ধা। করোনাকালীন সারা দেশের মতো চাঁদপুরে চিকিৎসাসেবায় নিরলস কাজ করে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এই চিকিৎসক দম্পতি।
এই দম্পতির একমাত্র সন্তানকে তার দাদা-দাদির কাছে রেখে, জীবনের ঝুঁকি উপেক্ষা করে দিনরাতের অধিকাংশ সময় করোনা চিকিৎসায় ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। এমন কঠিন সময়ে সহকর্মীদের অনেকেই যখন আত্মরক্ষায় নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছিলেন, তখন তারা সব মায়া ত্যাগ করে করোনাবিরোধী সংগ্রামে দায়িত্ববোধ ও সাহসিকতার মাধ্যমে নিজেদের নিয়োজিত করেছেন মানুষের সেবায়।
বিজ্ঞাপন
করোনা সংক্রমণের শুরুতেই চাঁদপুর থেকে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) করোনাবিষয়ক প্রশিক্ষণে ডা. রুবেল ও ডা. পলিন দম্পতি অংশ নেন। আর প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তিপদ্ধতির মাধ্যমে আন্তরিকতা দিয়ে করোনাযুদ্ধে শামিল হয়েছেন জনকল্যাণে।
চাঁদপুর জেলায় করোনার রোগী বাছাই, নমুনা সংগ্রহ ও চিকিৎসা বিষয়ে যেসব চিকিৎসকের নাম সর্বোচ্চ ধাপে, তাদের মধ্যে শীর্ষে ডা. রুবেল-ডা. পলিন দম্পতি। এখনো নিরলসভাবে সেবা দিয়ে চলেছেন মানবতার এই সেবকদ্বয়। সেবা নিতে আসা মানুষ, শনাক্তকৃত রোগী, স্বজন, সহকর্মী ও স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারাও তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। শুধু তা-ই নয়, স্বাস্থ্য বিভাগের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক এই চিকিৎসক দম্পতিকে ভূষিত করেছেন করোনাযুদ্ধের ‘জেনারেল’ হিসেবে।
ডা. সুজাউদ্দৌলা রুবেল চাঁদপুর সরকারি জেনারেল (সদর) হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) হিসেবে কর্মরত। মেধাবী ও পরিশ্রমী এই চিকিৎসককে করোনাবিষয়ক ফোকালপার্সন এবং মেডিকেল টিমের প্রধান মনোনীত করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত যে শতভাগ সঠিক ও সময়োপযোগী ছিল, ডা. রুবেল তার কাজের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত প্রমাণ রেখে চলেছেন। হাসপাতালের নিয়মিত দায়িত্বের পাশাপাশি চিকিৎসা নিতে আসা লোকদের করোনা সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করে নমুনা সংগ্রহের ব্যবস্থা করা, করোনার উপসর্গ নিয়ে আসা লোকদের নমুনা সংগ্রহ করা, তাদের প্রাথমিক চিকিৎসাপত্র দেওয়া, শনাক্তকৃত রোগীদের হাসপাতাল অথবা বাসায় (আইসোলেশন/কোয়ারেন্টাইন) চিকিৎসার বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান ও চিকিৎসাপত্র দেওয়া, আইসোলেশনে চিকিৎসাধীন রোগীদের বাড়তি নজর রাখা— একাধারে এসব কাজ করতে হয় তাকে।
এর পাশাপাশি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, মিডিয়াকর্মী, রোগী ও তাদের স্বজনসহ আরও অনেকের সঙ্গে কথা বলতে হয়, তথ্য দিতে হয়। পরম ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সঙ্গে হাসিমুখে এত সব সামাল দিচ্ছেন ডা. রুবেল। এমন নিখুঁত সমন্বয় হয়তো তার পক্ষেই কেবল সম্ভব ছিল।
অন্যদিকে ডা. সাজেদা বেগম পলিন চাঁদপুর সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। চিকিৎসাসেবায় তিনিও অবদান রাখছেন অন্যভাবে। চিকিৎসা পরামর্শের পাশাপাশি তার বাড়তি কার্যক্রম ছিল, করোনায় আক্রান্ত বা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তির বিশেষ ব্যবস্থায় দাফন করা এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সন্দেহভাজন ব্যক্তির বাড়িতে চিকিৎসা দল পাঠিয়ে নমুনা সংগ্রহের ব্যবস্থা করা।
দায়িত্বের মধ্যে না পড়লেও তার বাড়তি একটি কার্যক্রম এখন পুরো স্বাস্থ্য বিভাগের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে তিনি ‘কোভিড-১৯ হেল্পলাইন’ নামে একটি ফেসবুক পেজ খুলে সেখানে প্রতিদিন ভিডিও লাইভের মাধ্যমে করোনা বিষয়ে তথ্য, পরামর্শ, চিকিৎসা ও সতর্কতা তুলে ধরছেন। সেই পেজে সরাসরি জবাব দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরাও।
‘কোভিড-১৯ হেল্পলাইন’-এর আওতাধীন চিকিৎসকদের নিয়ে ২৪ ঘণ্টাব্যাপী মোবাইল ফোনের মাধ্যমে করোনাবিষয়ক টেলিমেডিসিন সেবা দিয়ে চলেছেন ডা. পলিন। এতে মানুষ ব্যাপকভাবে উপকৃত হচ্ছেন। এই উদ্ভাবনী প্রতিভারও সময়োপযোগী সেবাও মানুষ পাচ্ছে।
করোনাকালীন একটি বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে ডা. সুজাউদ্দৌলা রুবেলের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। তিনি বলেন, একটি বছর আগে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাস মহামারিরূপে এসেছে। গত বছরের মার্চ মাস থেকে আমরা করোনা রোগী শনাক্ত শুরু করি। এতে চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের আরএমও এবং ফোকালপার্সন হিসেবে কাজ শুরু করি আমি। করোনার শুরুতেই আমাদের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। সবার মধ্যে একপ্রকার ভীতি জন্ম নিয়েছিল তখন। যে কারণে আমাদের চিকিৎসক, নার্স, আয়ার সংকট ছিল।
করোনা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সবচেয়ে কষ্টের যে বিষয়টি দেখেছি, সেটি হলো বাবা-মা করোনায় আক্রান্ত হওয়ার কারণে সন্তানরা তাদের ফেলে যাচ্ছে। আবার পরিবারের ছেলে-মেয়ে কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে কেউ পাশে যাচ্ছে না। এই যে এক নির্মম পরিণতি, যা মানুষ মানুষকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। করোনাকালীন ঠিক সেই মুহূর্তে আমাদের ওপর দায়িত্ব অর্পিত হয়। আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছি।
ডা. রুবেল বলেন, আমরা স্ত্রী ডা. সাজেদা বেগম পলিন চাঁদপুর সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত রয়েছে। তার দায়িত্ব ছিল পুরো চাঁদপুর সদরের। সেও করোনার পুরো সময় কাজ করেছে। আমরা স্বামী-স্ত্রী মিলে করোনার পুরো সময় দায়িত্ব পালন করি। আর এ কাজ করতে গিয়ে চাঁদপুর সিভিল সার্জন, হাসপাতালের সহকারী পরিচালক, বিএমএর সাধারণ সম্পাদকসহ বিভিন্ন চিকিৎসকের সহযোগিতা পেয়েছি। তখনকার প্রেক্ষাপট এখন ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। এমনও সময় গেছে, আমাদের সন্তান ও মা-বাবাকে রেখে রাত দুইটা-তিনটার সময় রোগীর বাসায় যেতে হয়েছে।
আগের চেয়ে করোনার মহামারি অনেক কমে গেছে। তারপরও আমাদেরও সাবধানে থাকতে হবে জানিয়ে ডা. রুবেল বলেন, আমরা করোনার পুরো একটি বছর কাটিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অক্লান্ত পরিশ্রমে ভ্যাকসিন পেয়েছি। যেখানে বিশ্বের মাত্র ২৫টি দেশ ভ্যাকসিন পেয়েছে, সেখানে ভ্যাকসিন দিলেই যে আমরা পুরোপুরি করোনামুক্ত হব, তা কিন্তু নয়, আমাদের সার্বক্ষণিক মাস্ক পরাসহ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। যারা অফিস-আদালতে কাজ করি, তাদের অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। মানুষের কাছে আমাদের একটাই চাওয়া, আমাদের সহযোগিতা করা।
কথা হয় ডা. সাজেদা পলিনের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশ করোনাভাইরাস শনাক্তের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। আর চাঁদপুরে গত বছরের ৮ এপ্রিল করোনা রোগী শনাক্ত করা হয়। একটি বছর ধরে মানুষকে সচেতন করার জন্য আমরা ব্যাপকভাবে প্রচারণা চালিয়েছি। বিশেষ করে আমার একটি ফেসবুক পেজ (কোভিড-১৯ হেল্পলাইন) থেকে অন্য চিকিৎসকদের সহায়তার চেষ্টা করেছি। কোভিডের হাত থেকে বাঁচার জন্য কীভাবে সচেতন থাকতে হবে এবং স্বাস্থ্যশিক্ষা প্রদান, কোভিডের লক্ষণ আছে, এমন ব্যক্তিদের সেবা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। এ ছাড়া প্রতিদিন কতজন রোগী আক্রান্ত হচ্ছে, কতজন সুস্থ হচ্ছে, তার আপডেট আমার পেজে তুলে ধরা হতো।
ডা. পলিন বলেন, আমি আর স্বামী (ডা. সুজাউদ্দৌলা রুবেল) করোনার পুরো সময়টা লড়াই করেছি সমাজের জন্য, দায়িত্ববোধ থেকে। চাঁদপুর সদর উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের পাশাপাশি চাঁদপুর শহরের এখন ১৫ ওয়ার্ডও আমাদের দেখতে হয়েছে। কাজের সময় আমার ছেলেকে খুব মিস করেছি। এ ছাড়া বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়িকে বাসায় রেখে বাইরে কাজ করেছি। সব সময় ভয় কাজ করত, তারা আক্রান্ত হন কি না। মানুষের উপকারে আসতে পেরে ভেতরের সব কষ্ট ভুলে গেছি।
চাঁদপুরে ফেব্রুয়ারি থেকে করোনা ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হয়েছে। আর এই ভ্যাকসিন প্রদানে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। এই ভ্যাকসিনের মাধ্যমে চাঁদপুরকে খুব দ্রুত করোনামুক্ত করা যাবে। যারা ভ্যাকসিন দেননি, জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে তাদের ভ্যাকসিন দেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।
চাঁদপুরে আমরা সর্বদায় সমন্বিতভাবে কাজ করছি। ইনশা আল্লাহ, আমাদের সবার প্রচেষ্টায় করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারব, এমনটাই মনে করেন ডা. সাজেদা পলিন।
এনএ