কেউ স্বামী-পরিত্যক্তা, আবার কারও স্বামী মারা গেছেন। কিংবা অভাবের সংসারে তিনি ছাড়া আর কেউ নেই। কারও স্বামী আছেন, কিন্তু কর্মঠ নন। ফলে জীবনের তাগিদে নামতে হয়েছে কাজে। আর নেমে পেয়েছেন সফলতা। সমাজের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে ব্যক্তি ও সংসারজীবনে হয়েছেন প্রশংসিত। অভাব তাড়িয়েছেন নিজ কর্মগুণে। ফিরেছে সচ্ছলতাও।

জীবনের কিছু পরিস্থিতি তাদের বাধ্য করেছে অধিকার আদায় করে নিতে। এভাবে অধিকারের সঙ্গে পরিচয় হতে হতে এখন তারা ক্ষমতাবান। একসময় যেসব নারীকে অবজ্ঞার চোখে দেখা হতো, সংসারের অতিগুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনে তাদের অর্থ ব্যবহৃত হয়। তাদের ছাড়া পারিবারিক সিদ্ধান্তও এখন নেয় না কেউ। পরিবার ও ব্যক্তিজীবনে পারস্পরিক সমঝোতার মেলবন্ধনও হয়েছে এখন।

বরিশাল জেলার আগৈলঝাড়া উপজেলার কালুরপাড় এলাকার বিবর্তন হ্যান্ডমেড পেপার প্রজেক্টের শতাধিক নারীর জীবনের গল্পটা এমনই। আজ তাদের প্রস্তুতকৃত পণ্য বহির্বিশ্বে রফতানি হয়। তাদের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে বাংলাদেশ। সংসার সমাজজীবনে তারা আজ গুরুত্বপূর্ণ।

এখানকার কর্মরত উৎপাদনকর্মীরা জানান, ডোবায় জন্ম নেওয়া কচুরিপানা সংগ্রহ করে তা কেটে গাঁজনপদ্ধতিতে মণ্ড তৈরি করা হয়। সেই মণ্ড থেকে উৎপাদন করা হয় কাগজ। উৎপাদিত কাগজ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের পণ্য বানান শ্রমিকরা। এ ছাড়া পাট দিয়েও কিছু পণ্য প্রস্তুত করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স, নরওয়েসহ ২১টি দেশে এসব পণ্য রফতানি হয়।

তবে শুরুর জীবনটা এমন ছিল না তাদের। ঢাকা পোস্টকে জানান তাদের সংগ্রামী জীবনের অধ্যায়। ৪৫ বছর বয়সী উৎপাদনকর্মী সুরলতা (ছদ্মনাম) জানান, জীবনে ঘটে যাওয়া বীভৎসতা। ১৯ বছর বয়সে প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন একজনকে। স্বামী কাজকর্ম কিছু করতেন না। কারণ, তিনি প্রায়ই মাদক সেবন করতেন। বাবার জমিতে চাষাবাদ করে টেনেটুনে চলত সংসার। আর তা নিয়ে সংসারে গন্ডগোল লেগেই থাকত। মাদক সেবনের প্রতিবাদ করায় খেতে হতো মারধর। শেষে স্বামীর ঘর ত্যাগ করেন।

কিন্তু ফিরে এসে বাবার ঘরেও আশ্রয় হলো না। অকূল পাথারে পড়ে গেল ভবিষ্যৎ। প্রতিবেশী একজনকে ধরে বিবর্তনে কাজ নিলেন। এখান থেকে সচ্ছলতা এল তার জীবনে। দেড় বছরের মাথায় মা-বাবাও ফেরত নিতে এলেন সেই নারীকে। এমনকি স্বামীও ফেরত নিলেন। আর সাড়ে সাত বছরের ব্যবধানে স্বামীর সংসারে তার প্রাধান্যই বেশি। মূলত স্বামীর কাছে অর্থের জন্য হাত পাততে হয় না বলে এখন আর কোণঠাসা হয়ে থাকতে হয় না। ওই নারীর অভিমত, এখনকার যুগে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করে দেয়।

আরেক সংগ্রামী নারী দুলু বিশ্বাস জানান, কাজের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বিভেদ করার কোনো সুযোগ নেই। সংসারের সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য দুজনকেই কাজ করতে হবে। অন্যথায় পিছিয়ে পড়তে হবে। এই নারী মনে করেন, পরবর্তী প্রজন্মের নারীদের উচিত সবকিছুকে তুচ্ছ করে এগিয়ে যাওয়া। নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য কাজ করা।

প্রোডাক্ট ও পেপার সেকশনের সুপারভাইজার নমিতা রায়। সামান্য কর্মী হিসেবে কাজে যুক্ত হয়ে পর্যাক্রমে এখন তিনি সুপারভাইজার পদে আসীন হয়েছেন। তিনি জানান, তার উপার্জিত অর্থে এক মেয়ে ও এক ছেলে স্নাতক শেষ করেছেন। স্বপ্ন আছে ছেলে-মেয়েদের প্রতিষ্ঠা করবেন। নিজের সন্তানদের নিজের উপার্জিত টাকায় লেখাপড়া করানোর আনন্দ বলে শেষ করা যাবে না উল্লেখ করে নমিতা বলেন, কে কী বলল, তা দিয়ে কাজে আসবে না। আমাকে কেউ অধিকার পাইয়ে দেবে না। কাজের মাধ্যমে অধিকার আদায় করে নিতে হয়।

সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বিবর্তনে কর্মব্যস্ত নারীরা আবার একে অন্যের জীবনের গল্পও জানেন। তা দিয়ে নিজেরাও শিক্ষা পান। কর্মরত নারী বিভা বিশ্বাস বলেন, অধিকার পেতে হলে কাজ করতে হবে। কাজ না করে কেউ অধিকার পায় না। তা ছাড়া কাজ করলে নিজেরও ভালো লাগে। সময়ও কাটে।

বিবর্তনের ব্যবস্থাপক অঞ্জন কুমার বিশ্বাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে যেসব নারী কাজ করেন, তাদের প্রত্যেকের জীবনে একেকটি ট্র্যাজেডি আছে। সেখান থেকেই মূলত ঘুরে দাঁড়াতে কাজে এসেছেন। এখন তারা নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন। সংসারে তার সিদ্ধান্ত ও মতামত স্থাপন করতে পেরেছেন। মূলত নারীর ক্ষমতায়ন বলতে একটি পরিবারের বিবেচনায় বলছি, সংসারে যার অবদান বেশি, তিনিই ক্ষমতাধর হন। সেই বিবেচনায় নারীকে এগিয়ে আসতে হবে অবদান রাখার জন্য। বাংলাদেশে এখন পারস্পরিক কাজ করার সুন্দর পরিবেশ রয়েছে। এখন পিছুটান পেছনে ফেলে এগিয়ে এলেই অধিকার বাস্তবায়িত হবে।

অঞ্জন কুমার বিশ্বাস জানান যে বিবর্তনের মূল চিন্তাই হচ্ছে গ্রামীণ নারীদের ক্ষমতায়নে কাজ করা। এখানে কাজ করে নারীরা আর্থিকভাবে সচ্ছল হন। এতে তিনি সমাজ ও পরিবারে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেন।

১৯৯৫ সালে আগৈলঝাড়ায় কার্যক্রম শুরু করে বিবর্তন। তখন মাত্র ১০ থেকে ১২ জন নারী এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এখন সেখানে ১১১ জন কর্মীর মধ্যে ১০৬ জনই নারী। পুরুষ কর্মকর্তা রয়েছেন মাত্র ৫ জন। ১০৬ জন নারীর মধ্যে আবার ৬ জন কর্মকর্তা। বাকি ১০০ জন প্রডিউসার বা উৎপাদনকর্মী শ্রমিক, যাদের বেতন ৫ হাজার টাকা থেকে ১৬ হাজার টাকা পর্যন্ত।

এই কর্মকর্তা জানান, এখানকার কচুরিপানা দিয়ে উৎপাদিত শৌখিন পণ্যসামগ্রী দেশের বাইরে রফতানি হয়। আর এসব নারীর উৎপাদিত পণ্য রফতানির মাধ্যমে বছরে দেড় কোটি টাকার মতো লাভ আসে।

এনএ