অভাবের সময়টাত হামরা আলু খায়া বাঁচি
চারদিকে চলছে আলু তোলার ধুম। খেত থেকে আলু তুলে ভরা হচ্ছে বস্তায়। কোথাও আবার আলুর স্তূপ। অনেক জায়গায় আলু তুলে নেওয়ার পর ফাঁকা হয়েছে খেত। এখন সেইসব খেতে বেড়েছে শিশুদের আনাগোনা। মালিকরা আলু তুলে নিয়ে যাওয়ার পরও মাটিতে কিছু আলু চাপা পড়ে থাকে। মাটি খুঁড়ে সেই আলু বের করে আনতে লাঙ্গল, কোদাল, বাশিলা হাতে ব্যস্ত হিরা, বৈশাখী, মোস্তাফিজরা।
দলবেঁধে আলু কুড়াতে আসা এসব শিশুর বেশিরভাগই দরিদ্র পরিবারের। যাদের পরিবারে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর দশা। এ কারণে তারা আলু সংগ্রহে নেমেছে। এদের কেউ স্কুলে, কেউবা মাদ্রাসায় পড়ালেখা করছে। বৃহস্পতিবার (১১ মার্চ) রংপুরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে শিশুদের আলু সংগ্রহ করতে দেখা যায়।
বিজ্ঞাপন
রংপুর নগরীর খটখটিয়া ফুল আমেরতল এলাকায় আলুচাষি আব্দুল মতিন ঢাকা পোস্টকে জানান, সাধারণত গ্রামে মাটি থেকে আলু তুলতে পুরুষদের চেয়ে নারী শ্রমিকদের কাজে বেশি নেওয়া হয়। আলু তোলার সময় কিছু কিছু আলু মাটিতে চাপা পড়ে যায়। পরে গ্রামের শিশুরা বাশিলা, কোদাল প্রভৃতি দিয়ে মাটি খুঁড়ে এসব আলু বের করে আনে। এদের কেউ কেউ হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান। আবার কারও পরিবারের অবস্থা ভালো থাকার পরও শখ করে আলু তুলতে আসে। তবে সবার টার্গেট মা-বাবাকে সাহায্য করা।
বাশিলা হাতে মাটি আলগা করে চাপাপড়া আলু কুড়াচ্ছিল বৈশাখী। সঙ্গে তার চার বছর বয়সী ছোট ভাই দীপ্ত। বাশিলার আঁচড়ে আলু তুলতে পেরে দুই ভাইবোনের চোখে মুখে আনন্দের ছাপ।
বিজ্ঞাপন
ময়নাকুটি এলাকার বৈশাখী বলছিল, ‘আমরা গরিব মানুষ। আমাদের নিজেদের কোনো জমিজমা নেই। মানুষের জমিতে থাকি। এখন স্কুল বন্ধ, ক্লাসও নেই। এ কারণে আলু কুড়াচ্ছি। এই আলু আমরা বাড়িতে নিয়ে সারাবছর রেখে খাবো।’
মোস্তাফিজার নামে এক ছাত্র বলে, ‘আমাদের আবাদ নাই। যারা আলু আবাদ করছে, তারা তো ভালো আলু তুলে নিয়ে গেছে। এখন আমরা ছোটরা চাপাপড়া আলু খুঁজে বের করছি। এই আলু দিয়ে পিকনিকও করি। আবার বাড়িতে রেখে সারাবছর খাই।’
কথা হয় খটখটিয়া ফুল আমেরতল এলাকার মোবাশ্বেরার সঙ্গে। আলু কুড়ানির দলের এই ক্ষুদে সদস্য বলে, ‘আলু তুলি আমরা পিকনিক খাই। বাড়িত আলু দিয়া আলুর দম, আলুর নাস্তা, আলুর চপ বানায়। খাইতে খুব ভালো লাগে। আলু দিয়া তো অনেক কিছু হয়। কিন্তু আমরা এই সময়ে আলু তুলি আনন্দ পাই। এই জন্যে সবায় মিলি বাইশ, কোদাইল, লাঙ্গল দিয়া মাটি আলগা করি আলু তুলি।’
সাধারণত আলু তোলার মৌসুমে প্রতিটি গ্রামে বিভিন্ন বয়সী শিশুরা এভাবেই আলু তুলে থাকেন। এটা গ্রামের দীর্ঘদিনের চেনা চিত্র। তবে অন্য সময়ে স্কুল ছুটির পর গ্রামের শিশুরা আলু তুললেও এবার করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আলু কুড়াতে দেখা যাচ্ছে তাদের। কুড়ানো আলু বাড়িতে হাড়ি-পাতিলে রেখে নয়তো বালুতে রেখে সারাবছর খাওয়ার জন্য সংরক্ষণ করা হয়। তবে এই মৌসুমে কুড়ানো আলু দিয়ে মসলামাখা আলু সিদ্ধ (আলুর দম), আলু ভর্তা করে খাওয়ার পাশাপাশি শিশুরা পিকনিক করেও খায়।
জলছত্র এলাকায় একটি আলুর খেতে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় নারী শ্রমিক রাশেদা বেগমের। তিনি বলেন, ‘হামার মতো বেটিছাওয়া কামলার চাহিদা বেশি, কিন্তু হাজিরা কম। সারাদিন আলু তুলি সইন্দা হইলে ২০০ টাকা পাই। এই টাকা দিয়া তো সংসার চলে না। কিন্তু গরিরের করার কিছু নাই। একটা পুরুষ মাইনষোক কামোত নিলে ৫০০ টাকা দেওয়া লাগে। আর হামাক কামোত নিলে খালি ২০০ টাকা।’
রাশেদা বেগম বলেন, ‘করোনাত গ্রামের বেশির ভাগ পুরুষ মানুষ বেকার হইছে। আগের মতো কাম কাজ নাই। ওই তকনে হামরা কষ্ট করি যা কামাই করি, তাকে দিয়া ছাওয়াপোয়ার নেকাপড়া করাই। হামার মতোন গরিব মানুষের ভালো আলু কিনি খাবার সামর্থ্য নাই। ছোট ছাওয়াগুলা যেকনা আলু কুড়ায়, তা দিয়া সারাবছর পার হয়। তাছাড়া আলুতো গরিবের গোস্ত। হামরা এটাকে মসলা দিয়া পাক করি গোস্ত মনে করি খাই।’
আলু উৎপানদকারী অঞ্চল হিসেবে রংপুরে চলতি মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আবাদ হয়েছে। আলুর বাম্পার ফলনে উচ্ছ্বসিত কৃষকরা। তবে ন্যায্য দাম আর আলু সংরক্ষণে হিমাগার সংকট না হলে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন কৃষকরা।
এদিকে করোনার শুরুর দিকে আলুর চাহিদা বৃদ্ধি ও আকাশছোঁয়া দাম ছিল। এ কারণে ভালো দাম পাওয়ায় অনেক কৃষক আলু চাষ বাড়িয়েছেন। এবার আগে ভাগেই দ্রুত বর্ধনশীল জাতের গ্রানোলা, লরা, মিউজিকা, ক্যারেজ, রোমানা ও ফাটা পাকরি আলু চাষ করেছেন চাষিরা। চলতি মাসের মধ্যেই খেত থেকে আলু উত্তোলন শেষ হবে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উদ্যান বিশেষজ্ঞ কৃষিবিদ খোন্দকার মো. মেসবাহুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে জানান, চলতি মৌসুমে রংপুর কৃষি অঞ্চলের পাঁচ জেলার মধ্যে রংপুরে ৫৩ হাজার ৫২৫ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে। এছাড়াও নীলফামারীতে ২৭ হাজার ২৭০ হেক্টর, গাইবান্ধায় ৯ হাজার ২৫০ হেক্টর, কুড়িগ্রামে ৬ হাজার ৫৪৫ হেক্টর এবং লালমনিরহাটে ৫ হাজার ৭২৫ হেক্টর জমিতে আলু আবাদ হয়েছে।
তিনি আরও জানান, রংপুর অঞ্চলে আলু সংরক্ষণে ৬৭টি হিমাগার রয়েছে। এর মধ্যে ৪০টি হিমাগার রয়েছে রংপুরে এবং ১০টি নীলফামারীতে। বাকি তিন জেলায় ১৭টি হিমাগার রয়েছে।
আরএআর