রংপুরের ভাষাসৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মজিবর রহমান মাস্টার ‌‘একুশে পদক-২০২৩’ এর জন্য মনোনীত হয়েছেন। গতকাল রোববার (১২ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব বাবুল মিয়া স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ দেশের ১৯ জন বিশিষ্ট নাগরিক ও দুই প্রতিষ্ঠানকে এ বছর একুশে পদক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আগামী ২০ ফেব্রুয়ারি পদকপ্রাপ্তদের হাতে একুশে পদক-২০২৩ তুলে দেওয়া হবে।

এ বছর বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্যে ভাষা আন্দোলনে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ পদক পাচ্ছেন তিনজন। তাদের মধ্যে একজন গুণী শিক্ষক, ভাষাসৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মজিবর রহমান মাস্টার। তিনি রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার কুতবপুর ইউনিয়নের খিয়ারপাড়া গ্রামের সেরাজ উদ্দিনের ছেলে। ১৯৩৭ সালে ওই গ্রামে তার জন্ম হয়।

মজিবর রহমান মাস্টারের এক ছেলে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মোস্তাফিজার রহমান মজনু ও আরেক ছেলে মোস্তাকুর রহমান পেশায় প্রকৌশলী। মেয়ে মোনসেফা খানম গৃহিণী। তার একুশে পদক প্রাপ্তির সংবাদে খুশি পরিবার-পরিজনসহ গ্রামবাসী। সোমবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) সকালে ভাষাসৈনিক মজিবর রহমান মাস্টারের বাড়িতে গিয়ে শুভেচ্ছা জানান জেলা প্রশাসক ড. চিত্রলেখা নাজনীনসহ উপজেলা প্রশাসন।

দুপুরে ঢাকা পোস্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মজিবর রহমান মাস্টার তাকে একুশে পদকে সম্মানিত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষাসহ সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ভিশনে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার প্রচেষ্টার সফলতা কামনা করেন।

এই ভাষা সংগ্রামী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১৯৪৮ সালে বদরগঞ্জ হাই স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। তখন আমি এখানকার লোকজনের সঙ্গে পাকিস্তানের নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে দেখার জন্য ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে একটি সমাবেশে গিয়েছিলাম। ওই সমাবেশে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। আমরা তখন নো নো বলে স্লোগান দিয়েছিলাম। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও একটি অনুষ্ঠানে একই ঘোষণা দেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। সেখানে ছাত্ররা তীব্র প্রতিবাদ করেন।

তিনি আরও বলেন, স্থানীয় রামনাথপুর গ্রামের ডাক্তার নাসিম স্যারের সঙ্গে আমরা পোস্টার লিখি ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। ঢাকা থেকে ফেরার পর ইদ্রিস লোহানী ও ইউনুস লোহানীর বাড়িতে গিয়ে অবস্থান করি। বদরগঞ্জের তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা জীতেন দত্ত, ইদ্রিস লোহানী ও ইউসুফ লোহানীর অনুপ্রেরণায় ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত হই।

মজিবর রহমান বলেন, আমরা বিভিন্ন শহর ও গ্রামে স্কুল-কলেজে ক্যাম্পেইন করি। যাতে ছাত্ররা আন্দোলনমুখী হয়ে ওঠে। বুড়িপুকুর, লালদিঘিরহাট, সয়ার খোড়াগাছ, শ্যামপুরে ক্যাম্পেইন করি। এমনকি সাধারণ মানুষও আমাদের আন্দোলনের পক্ষে ছিল। সবাই মাতৃভাষা বাংলা চাই। তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মচারীদের পক্ষে আন্দোলন করায় জেলখানায় বন্দি ছিলেন। ওখান থেকে উনি চিরকুট পাঠিয়ে দেন বাংলা ভাষার জন্য আমরা যেন আন্দোলন করি। আমি ১৯৫২ সালে মেট্রিক পরীক্ষার্থী। ভাষার দাবিতে আন্দোলন করায় আমার নামে ওয়ারেন্ট হয়।

এই ভাষাসৈনিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পর স্বাধিকার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার সুবাদে নাছোড় বান্দার মতো চষে বেড়ান সবখানে। সেই স্মৃতির কথা তুলে ধরে মজিবর রহমান  বলেন, রংপুর মহকুমায় সব জায়গায় আন্দোলন করেছিলাম। মতিউর রহমান মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৭০ সালে ভোট ক্যাম্পেইনে রংপুর কালেক্টরেট ময়দানে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তখন আমি শ্যামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। বঙ্গবন্ধুর ওই সভায় ছাত্র-শিক্ষকসহ অনেককে নিয়ে গিয়েছিলাম। সঙ্গে ওই সভায় ছয়টা রুপার চান্দি (রুপার মুদ্রা) নিয়ে গিয়েছিলাম। তখন বঙ্গবন্ধু আমাকে মঞ্চে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসা করেন- ‘তুমি এটা করলে কেন?’ আমি বললাম ৬ দফাকে স্মরণ রাখার জন্য এটা করছি। তখন বঙ্গবন্ধু আমার পিঠে থাপ্পড় দিয়ে বলেন- ‘সাবাস সাবাস।’

১৯৭১ সালে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ভাষণের পর মজিবর রহমান মাস্টার বদরগঞ্জে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। তিনি ওই কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। আহ্বায়ক ছিলেন এমএলএ এলাহী বকস্ সরকার। তবে তাকে শ্যামপুর আঞ্চলিক সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক করা হয়েছিল।

মজিবর রহমান মাস্টার বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু এই তিনটি স্লোগানকে বুকে ধারণ করে ২৮ মার্চ হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষকে সঙ্গে নিয়ে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করতে গিয়েছিলেন। সে সময় পাক হানাদারের গুলিতে অসংখ্য বাঙালি শহীদ হন।

তিনি মুক্তিযুদ্ধে ৬ নম্বর সেক্টরে থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। পহেলা এপ্রিল সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ক্যাপ্টেন আনোয়ারের নেতৃত্বে ৩ শতাধিক আনছার, পুলিশ ও সেনা সদস্য বদরগঞ্জে আসেন। সেই বহরে অংশ নেন মজিবর রহমান মাস্টার। বদরগঞ্জ থেকে তারা দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে যান। সেখানে তাদের গ্রেনেড দিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার প্রশিক্ষণ শুরু করেন।

৬নং সেক্টরের কমান্ডার ক্যাপ্টেন নোয়াজেসের সঙ্গে তিনি নীলফামারীর চিলাহাটির তিনটি স্থানে গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেন। পরে তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের সঙ্গে কলকাতায় দেখা করেন। তার নির্দেশে ভারতের কুচবিহারের টাপুরহাট ইয়ুথ ক্যাম্পে সহকারী রিক্রুটিং অফিসার হিসেবে যোগ দেন। স্বাধীনতার পর তিনি কয়েক বছর বিসিআইসি চেয়ারম্যান ছিলেন। স্কাউটস আন্দোলনে যুক্ত থেকে রাষ্ট্রপতি পদকও পান। 

মজিবর রহমান মাস্টার স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর নেতা ও যুদ্ধাপরাধী এটিএম আজহারুল ইসলামের মামলায় সাক্ষী ছিলেন। তাকে বহুবার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। তা উপেক্ষা করে তিনি সাক্ষ্য দিয়েছেন। এ কারণে তিনি জামায়াত-শিবিরের হামলার শিকারও হন। মজিবর রহমান মাস্টারের গ্রামের পাশের গ্রামে এটিএম আজহারুল ইসলামের বাাড়ি।

মজিবর রহমান ১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বদরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাকশাল গঠনের পর তিনি দীর্ঘদিন রংপুর জেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এ ছাড়া তিনি বদরগঞ্জ শাখা টিসিসির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সে সময় তিনি বদরগঞ্জের কুতুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যনও ছিলেন।

যুব সমাজের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছি, সেরকম তারা যেন ১৯৪১ সালে দেশকে বিশ্বের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত করে।

ভাষা সংগ্রামী মজিবর রহমান মাস্টার বলেন, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও ঢেলে সাজাতে হবে। দেশকে উন্নত করার জন্য শহরকেন্দ্রিক শিক্ষার ব্যবস্থা করলে হবে না। গ্রামপর্যায়ে শিক্ষা নিয়ে কাজ করতে হবে। সময়োপযোগী শিক্ষার মাধ্যমে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী গড়ে তুলতে হবে। তাহলে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার যে স্বপ্ন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন, তা সফল ও সার্থক হবে।

এ সময় তিনি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, আমি খুবই খুশি। দেশ-জাতির জন্য কাজ করায় প্রধানমন্ত্রী আমাকে সম্মানিত করেছেন। আল্লাহর কাছে তার দীর্ঘায়ু কামনা করছি। আল্লাহ যেন প্রধানমন্ত্রীকে দীর্ঘায়ু দান করেন। 

এদিকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননায় ভূষিত হওয়ায় খুশি মজিবর রহমানের ছেলে মোস্তাফিজার রহমান মজনু। বদরগঞ্জের নাটারাম উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক এই সহকারী শিক্ষক বলেন, খুব ভালো লাগছে আমার বাবাকে সরকার একুশে পদকের জন্য মনোনীত করেছে। আমরা রংপুরের মানুষ সরকার প্রধানের কাছে কৃতজ্ঞ।  ভাষা আন্দোলন থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধে আমার বাবা জীবনের মায়া ভুলে অংশ নিয়েছিলেন। আজ সেই অবদানের স্বীকৃতি মিলেছে।

মজিবর রহমান মাস্টারের বড় ছেলের মেয়ে খায়রুম নাহার বলেন, আমার দাদাকে সরকার একুশে পদক দিচ্ছে, এটা আমাদের জন্য গর্বের এবং গৌরবের। আমি বেশি আনন্দিত। কারণ ঢাকা থেকে প্রথমে আমাকে ফোন করে দাদাকে যে একুশে পদকের জন্য মনোনীত করা হয়েছে, তা জানানো হয়। তখন আমি আনন্দে কেঁদে ফেলেছি। এই প্রাপ্তি আমার দাদার হলেও আমাদেরকে দেশের এবং মানুষের জন্য ভালো কিছু করতে আরও বেশি অনুপ্রাণিত করবে।

আরএআর